জাতীয় শিক্ষাক্রমে যে বিষয়টি অন্তুর্ভুক্তি জরুরি
ভাস্কর রাসাঃ ধরা যাক, আমি একজন শিক্ষার্থী। সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। এখন অনার্সে ভর্তি হবো। পারিবারিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতির পরিবেশে বড় হয়েছি। সেই ছোট বয়স থেকে জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে আমার প্রবল আগ্রহ। তাই বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি, এমনকি বিশ্বে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি তথা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চতর অধ্যয়নের ইচ্ছা সেই সময় থেকেই। আজ উপযুক্ত সময় হয়েছে, উল্লিখিত বিষয় নিয়ে অনার্সে ভর্তি হবো। কিন্তু এ কী! জাতীয় সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই! এ বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে বিভাগ নেই।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘোরাঘুরি করে জানতে পেরেছি– জাতীয় সংস্কৃতি বিভাগ নেই; ভর্তি হতে হবে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে। এ বিভাগে ভর্তি হলে কি আমি জাতীয় সংস্কৃতি বিষয়ে কোনো পাঠ্যক্রম পাচ্ছি? এটি হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। এ থেকে প্রতীয়মান, এই বিভাগে পড়ানো হবে ইসলামের ইতিহাস। সঙ্গে যে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি কি ইসলামের সংস্কৃতি? বিভাগের নাম থেকে বোঝা যায়, ইসলামের ইতিহাসের পাশাপাশি ইসলামিক সংস্কৃতিই পড়ানো হয়। এখানে জাতীয় সংস্কৃতি পাঠের সুযোগ নেই।
একটি জাতি গঠনের অন্যতম বিষয় সেই জাতির সংস্কৃতি; ইতিহাস ও কালপ্রবাহে একটি জাতিতে অনেক ধর্মীয় সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটে। যেমন বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি, বাঙালি বৈদিক সংস্কৃতি, বাঙালি খ্রিষ্টানের সংস্কৃতি, বাঙালি বৌদ্ধ সংস্কৃতি। এখানে লক্ষণীয়, আমরা বাঙালি হলেও নাম হচ্ছে ইসলামিক, বৈদিক, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ। আবার প্রত্যেকেরই নিজস্ব খাদ্যতালিকা আছে। আছে পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মীয় রীতি-নীতি। আবার ভাষা, প্রকৃতি ও ফসলাদির দিকে দৃষ্টি দিলে এখানে অভিন্নতা লক্ষণীয়।
জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির যোগসূত্রও আছে। এ যোগসূত্র ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রকৃতিগত। যেমন এ দেশে বধূর বিয়ের শাড়ির রং লাল, আবার বিলেতে তা সাদা। আমরা গর্ব করে বলি, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। ৫৬০ সালে নাথ পুঁথির পথ ধরে চর্যাগীতিকা থেকে আজ অবধি বাঙালি সংস্কৃতি প্রবহমান। আমাদের সংস্কৃতির এই দীর্ঘতম যাত্রায় ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত। ঘটেছে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন।
জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান সংস্কৃতি। জাতীয় সংস্কৃতি একটি গর্বের বিষয়। অথচ এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমের উচ্চতর পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নেই। যেসব বিজ্ঞজন জাতীয় শিক্ষাক্রমে বর্তমানে যুক্ত বা ছিলেন, তাঁরা কি একবারও জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়টি শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি? কেন করেননি বা নির্দেশিত হননি, সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
সংস্কৃতি বিভাগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি নামে একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিভাগ চালু করা প্রয়োজন। সংস্কৃতিচর্চায় উচ্চতর পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন এই জরুরি বিষয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ পায়। সংস্কৃতির মধ্যে অনেক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। যেমন– জাতীয় সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি, সংস্কৃতির আদি-মধ্য ও বর্তমান পর্ব, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি চিত্রকলা, নাট্যকলা, সাহিত্য, ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন বিভাগে পাঠ্যক্রমের মধ্যে সংস্কৃতি বিষয় আছে। তবে তা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিবিষয়ক পাঠের পরিপূরক নয়।
আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চতর অধ্যয়নের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে পাঠ নিতে পারছেন না। ভবিষ্যতে জাতীয় শিক্ষাক্রমে উল্লিখিত বিষয়টি যেন সংযুক্ত করা হয়। আমি শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও আগামীতে আগ্রহীরা যেন এ বিষয়ে পড়তে পারেন।
লেখক: ভাস্কর্যশিল্পী (ভাস্কর রাসা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো ইনস্টিটিউশন থেকে পড়ালেখা করে বেড়ে ওঠা ভাস্কর-শিল্পী নন। তিনি ছেলেবেলা থেকেই নিজের চর্চা ও শিল্পবোধের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া এক কলাজ্ঞ।)
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়