একজন শিক্ষকের হাতেই তৈরি হন রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী!
অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলামঃ ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাংলা পাঠ্যক্রমে পরলোকগত প্রখ্যাত শিক্ষক ও সাহিত্যিক কাজী কাদের নওয়াজ সাহেবের একটি কবিতা ছিল উপরোক্ত শিরোনামে। অনেকেরই হয়তো মনে আছে। বাদশাহ আলমগীরের ছেলেকে এক শিক্ষক পড়াতেন। একদিন সকালে শিক্ষক অজু করার সময় বাদশাহপুত্র তার পায়ে অজুর পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। ঘটনাটি বাদশাহের চোখে পড়ে যায়। শিক্ষক এ ব্যাপারে ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এই ভেবে, না জানি বাদশাহ এ জন্য তাকে কী শাস্তি দেন! শাহজাদার হাতে পা ধোয়ার জন্য পানি ঢেলে নেয়া! এ তো বড় সাঙ্ঘাতিক কাজ! এ অবস্থার ভেতর বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাদশাহপুত্র কেন নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেয়নি, কেবল পানি ঢেলে দিয়েছে? এ জন্য তিনি খুবই দুঃখিত ও মর্মাহত হয়েছেন। এতে শিক্ষকের প্রতি শাহজাদার সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব প্রকাশিত হয়েছে। এভাবেই সেদিন শিক্ষকের মর্যাদাকে উচ্চকিত করেছিলেন বাদশাহ আলমগীর।
ইসলামে শিক্ষককে শায়খ বা শেখ বলা হয়েছে। অনেক সময় আল্লামাও বলা হয়। প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালকে যখন ডক্টরেট উপাধি দেয়ার প্রস্তাব করা হয় তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন এই বলে যে, তার শিক্ষক মৌলভী মির হাসান আলীকে ‘শামসুল উলামা’ উপাধি দেয়ার আগ পর্যন্ত যতক্ষণ তার শিক্ষককে ‘আল্লামা’ উপাধিতে সম্মানিত করা না হয় তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত ডক্টরেট উপাধি গ্রহণে অপারগ। ফলে তার শিক্ষককে প্রথমে আল্লামা উপাধিতে সম্মানিত করা হয়। নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালামও তার নোবেল প্রাপ্তির কথা প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ তিনি তার নোবেল প্রাপ্তির কথাটি নিজেই তার শিক্ষককে জানাতে চেয়েছিলেন। এমনকি প্রফেসর ড. সালাম তার শিক্ষক মি. গাঙ্গুলীকে খুঁজে বের করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। এটি আসলে শিক্ষকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ।
বৌদ্ধ ধর্মে শিক্ষাগুরুরা হচ্ছেন মহান্ত। আরো শ্রদ্ধায় যারা অভিষিক্ত তারা হচ্ছেন লামা। নিউ টেস্টামেন্টে শিক্ষকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘তারা মঙ্গলের জন্য পরিশ্রম করেন, ক্ষতিকর বিষয়গুলো সম্পর্কে সাবধান করেন, তাদের শ্রদ্ধা করো।’
ক্যাথলিক চার্চে শিক্ষক সম্পর্কে বলা হয়- ‘ব্যক্তির সম্মান যেকোনো সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি। শিক্ষকরা তারই শিক্ষা দেন।’ ইসলাম ধর্মে শিক্ষকের উচ্চ মর্যাদার কথা কে না জানে! স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ এ হাদিস থেকে প্রতিভাত হয়, শিক্ষকরা নবীদের উত্তরসূরি।
মহাভারতে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ একলব্য তার ছায়াগুরু দ্রৌনাচার্য্যকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে উপহার দিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ শিক্ষকদের ব্যাপারে বলেছেন- ‘তারা তোমাদেরকে সঠিক জ্ঞান, ধৈর্য, সহানুভ‚তি, সৎসঙ্গ এবং সদ্ভাবের শিক্ষা দেন। তাদেরকে শ্রদ্ধা করো।’ এভাবে প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসে শিক্ষকদের সম্মান করার ব্যাপারে বারবার সচেতন করা হয়েছে। প্রতিটি সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকদের মর্যাদা প্রাচীনকাল থেকেই সমুন্নত করা হয়েছে। শিক্ষকরা হারিয়ে যাওয়া সত্যকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। সত্যকে ধারণ করেন, লালন করেন।
বস্তুত একজন শিক্ষক নিজে কখনো রাষ্ট্রপতি হন না, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হন না। কিন্তু তাদের হাতেই তৈরি হয় রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সেনাপতি, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী, আমলা ও কৃষিবিদ। এ জন্যই তাদের বলা হয়ে থাকে মানুষ গড়ার কারিগর। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তারা এগিয়ে যাওয়ার, বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখান। দেশপ্রেমের হাতেখড়ি হয় তাদের কাছেই। ছাত্রদের কাছে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকে না। নিঃস্বার্থভাবে সারা জীবন তারা নীরবে জাতির ভবিষ্যৎকে তৈরি করেন। তাদের এই নিঃস্বার্থ ত্যাগ জাতিকে এগিয়ে নেয়। এ জন্য সৃষ্টির শুরু থেকেই তারা শ্রদ্ধার পাত্র। অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস থেকে শুরু করে আজকের প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষক এ জন্যই সমান কাতারে।
এখন সময় পাল্টেছে। পরিবর্তিত হয়েছে জীবনবোধ। আর এই পরিবর্তিত সমাজ চেতনার ধারায় শিক্ষকরা আজ তাদের ছাত্র, তাদেরই হাতে তৈরি আমলা, ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের হাতে নিগৃহীত, অপমানিত, লাঞ্ছিত। আজ শিক্ষককে অপমান করা, প্রকাশ্যে নিগৃহীত করা যেন ক্ষমতার মদমত্ততার একটি প্রকাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস। অবশ্যই এর জন্য শিক্ষকসমাজও কম দায়ী নন। তারাও দলবাজির প্রতিভ‚ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কোচিং ব্যবসায়, তাদের সুনজরে থাকা শিক্ষার্থীদের বেশি নম্বর দেয়া, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িয়ে যাওয়া, তাদের শ্রদ্ধাবোধের চেতনাকে কালিমা লিপ্ত করেছে। তাদের হাতে তৈরি হচ্ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তারাই নিজ শিক্ষককে অবলীলায় নিগৃহীত করছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ব্যাপারটিকে আরো কলুষিত করছে। সুন্দর সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন জাতি তৈরির জন্য পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগ্যতা অর্জনের প্রজন্ম তৈরির প্রয়োজনে শিক্ষক নিগ্রহ বন্ধ করার ব্যাপারে সবার সোচ্চার হওয়া একান্তই জরুরি।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়