আর.কে চৌধুরী কলেজ: দুর্নীতিতে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের চাকরি গেলেও বহাল সঙ্গীরা
আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে নেই কোন শিক্ষার্থী, শিক্ষক আছেন তিন জন। তেমনই হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী আছে চার জন করে শিক্ষক আছেনও চার জন অর্থ্যাৎ একজন শিক্ষক পড়ান একজন শিক্ষার্থীকে। মার্কেটিং বিভাগেও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী আছে মাত্র ১ জন, শিক্ষক আছেন তিনজন। একই চিত্র ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও সমাজকর্ম বিভাগেও। ক্ষমতাবান গুটিকয়েক শিক্ষকের অদক্ষতা ও দুর্নীতি ও অনিয়মে এভাবেই ডুবতে বসেছে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক সময়ের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কে চৌধুরী কলেজ। নাম মাত্র শিক্ষার্থী পড়িয়ে বেতন তুলছেন স্নাতকের (অনার্স) পাঁচ বিভাগের ১৮ জন শিক্ষক।
কয়েক কোটি টাকা দুর্নীতি করে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. ইসতারুল হক মোল্লা এবং উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলামের এমপিও বাতিল ও চাকরিচ্যুত হলেও তাদের অনিয়মের সঙ্গী পাঁচ শিক্ষক এখনও বহাল তবিয়তে থাকায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার পরিবেশ নিন্ম পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্নাতক বিভাগ চালু থাকলেও পাঁচ জন শিক্ষকের অনিয়নে ডুবতে বসেছে কলেজটি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং পড়াশুনার মান এখন নিন্ম পর্যায়ে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির অবস্থাও বেহাল।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্তে ৩০টি প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে ৪৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে জমা দেয় ডিআইএ। ডিআইএর এই প্রতিবেদনের আলোকে কলেজটির অধ্যক্ষ মো. ইসতারুল হক মোল্লা এবং উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলামের এমপিও বাতিল ও চাকরিচ্যুত হয়। ঐ প্রতিবেদন অনুযায়ী যাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে অধ্যক্ষ উপাধ্যক্ষের এই অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা উল্লেখ আছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এমনকি কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ফলে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষকে অপসারণ করা হলেও অভিযুক্ত অন্য শিক্ষকরা বহাল তবিয়তে থাকায় সহসায় শিক্ষার পরিবেশ এবং শিক্ষার্থী বাড়ছে না প্রতিষ্ঠানটিতে।
ডিআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, যাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন তারা হলেন, সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মাহবুবা আফরোজ, মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক রবীন্দ্র নাথ মদক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল ইসলাম, ফিন্যান্স বিভাগের প্রভাষক মোঃ আসলাম উদ্দীন । এছাড়াও রসায়ন বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলম (তৎকালীন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি।
ডিআইএর প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের পাঁচটি অনার্স বিভাগ শিক্ষা সফরে না গেলেও সহকারী অধ্যাপক মাহবুবা আফরোজ, সহকারী অধ্যাপক রবীন্দ্র নাথ মদক, সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল ইসলাম ও প্রভাষক মোঃ আসলাম উদ্দীনের প্রত্যক্ষ যোগসাজসে তিন লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ। এছাড়াও কলেজটির আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের সাথে অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষের সাথে প্রতক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন এই পাঁচ শিক্ষক। ডিআইএর প্রতিবেদনে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের যোগসাজসে একাধিকবার এই পাঁচ শিক্ষকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে।
সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মাহবুবা আফরোজ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, যে শিক্ষা বর্ষের শিক্ষা সফরের কথা বলা হচ্ছে সেই শিক্ষাবর্ষে আমার ডিপার্টমেন্ট শিক্ষা সফরে গিয়েছে। ডিআইয়ের কাছে আমি আমার সব ডকুমেন্টস দিয়েছি। সব তথ্য প্রমান দেওয়ার পরেও আপনার ডিপার্টমেন্টের নাম কেন আসল জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা তো আমি বুঝতে পারছি না। প্রমাণ দেওয়ার পরেও তারা কেন আমার ডিপার্টনেন্টের নাম দিলেন। আপনি এ বিষয়ে ডিআইয়ের কাছে কোন লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন কি'না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার তো কেউ পরিচিত নাই। এ দপ্তর থেকে সে দপ্তরে কে দৌড়াদৌড়ি করে। আমরা যে শিক্ষা সফরে গিয়েছে তার প্রমাণ এর আগে আমি একটি টেলিভিশন আসছিল তাদেরকেও দিয়েছি। এরপর তিনি শিক্ষা সফরের কিছু ছবি শিক্ষাবার্তা'র বার্তা কক্ষে প্রেরণ করেন।
তবে ডিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা সফর যে হয়েছে তার কোন প্রমাণ তদন্তকারী দলের নিকট অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ প্রেরণ করেননি এমন কোন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। এতে প্রমাণিত হয় যে শিক্ষা সফর না করেও শিক্ষা সফরের নামে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
কলেজের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, তৎকালীন কলেজ গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি ছিলেন মাহবুবা আফরোজ। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের প্রত্যক্ষ মদদ দাতা ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির এই দুই প্রশাসনিক কর্তা যে আর্থিক অনিয়ম করেছেন প্রত্যক্ষভাবে তার সাথে জড়িত ছিলেন মাহবুবা আফরোজ।
এ বিষয়ে মার্কেটিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক রবীন্দ্র নাথ মদক এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক মোঃ আসলাম উদ্দীনের মুঠোফোনে কল করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল ইসলাম একজন কাঠের ফার্নিচার ব্যবসায়ী। বিনা টেন্ডারে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের সহায়তায় তিনি কলেজে নানা ধরণের ফার্নিচার-যেমন, ওয়াল কেবিনেট, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের চেয়ার-টেবিল, সোফা, নিজ কক্ষের সোফা, টেবিল, ডায়াচ, লেকচার টেবিল কলেজের সকল কাঠের দরজা সরবরাহ করেছেন। এ ক্ষেত্রে বাজার দরের অধিক মূল্যে বিল ভাউচার করে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের সহায়তায় কলেজ থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ডিআইএর প্রতিবেদনে আত্মসাতের বিষয়টি সুপষ্টভাবে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে ডিআইয়ের প্রতিবেদনে উঠে আসা অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি। বিষয়টি মিমাংশিত বলে তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর তিনি পুনরায় মুঠোফোনে বলেন, আমি কোন অনিয়ম করিনি, ডিআইএর প্রতিবেদনটা একটু ভালো করে দেখেন।
উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলামের বন্ধু তৎকালীন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি রসায়ন বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলম কলেজে ৫/৬ বছর ধরে উপস্থিত না থেকে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করিয়েছেন। নিজে বেতন নিয়েছেন এবং প্রক্সি শিক্ষকেরও বেতন দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা মাত্র ০৪ জন। এই বিভাগে ৪জন সহকারী অধ্যাপক (পদার্থ, গণিত, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান) রয়েছেন-যাদের প্রত্যেকে প্রতিমাসে এমপিওরর সরকারি অংশ ৪৩,১৩৫/- টাকা এবং কলেজ বাড়িভাড়া বাবদ ১৫,০০০/- টাকা গ্রহণ করেন। বন্ধুত্বের পুরষ্কার হিসেবে উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলাম রসায়ন বিভাগের শিক্ষক সামসুল আলমের ক্লাস গ্রহণের জন্য ওয়ালিউল্লাহ ইতোমধ্যে প্রক্সি ক্লাস বাবদ ৫/৬ বছরে ৪-৫ লক্ষ টাকা নিয়ে গেছেন। মাত্র চারজন ছাত্র পড়িয়ে প্রায় ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) টাকা বেতন গ্রহণকারী সম্পূর্ণ সুস্থ শিক্ষক মোঃ সামসুল আলমকে এই অবৈধ ও অন্যায় সুযোগ দিয়ে লুটপাটের একটি চারণভূমি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।
কোন ধরণের ক্লাস না করিয়ে প্রক্সি শিক্ষকে দিয়ে করিয়ে বেতন ভাতা উত্তোলনের প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে রসায়ন বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলম কোন মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, আপনি অধ্যক্ষের সাথে কথা বলেন। এর কিছু সময় পর তিনি কলেজে নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন, ক্লাস নিয়েছেন এবং নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেছেন জানিয়ে প্রক্সি ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে বলেন, ওয়ালিউল্লাহ তিনি প্র্যাকটিক্যালের ক্লাস নিয়ে থাকতে পারেন। তবে আমার ক্লাস নেননি। আমার বিষয়ে আমার লিখিত বক্তব্য আমি ডিআরইয়ের কাছে উপস্থাপন করেছি। আমি কোন অনিয়ম করিনি। আপনি কলেজে আসেন অন্য যে সব শিক্ষকদের নাম বললেন আমরা আপনার সাথে কথা বলব দেখা করব। ডিআরইয়ের প্রতিবেদনে আপনি কোন ছুটি কিংবা অনুপস্থিতি থাকার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি এবং প্রক্সি ক্লাস নেওয়ার বিষয়েও গভর্নিং বডি কোন সিদ্ধান্তের রেজুলেশন দেখাতে পারেননি। বিষয়টি প্রমাণিত উল্লেখ রয়েছে। এসময় তিনি বলেন, কলেজে আসেন বিস্তারিত কথা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জহিরুল হক মৃধা শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমি নতুন ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে আছি। খুব বেশিদিন হয়নি দায়িত্ব নেওয়ার। অনিয়মগুলো তো আগের তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। বিষয়টি নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে দেখতে হবে। এই মূহুর্তে এটা নিয়ে কিছু বলতে পারছি না।
আরকে চৌধুরী কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি মো. আমজাদ হোসেন আখন্দ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আসলে প্রতিষ্ঠানটির যা অবস্থা শিক্ষার্থী নাই বললেই চলে। যদি আপনারা ফের নিউজ করেন তাহলে আবার ঝামেলায় পড়তে হবে। অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের অপকর্মের সঙ্গী মাত্র পাঁচ জন শিক্ষক এদের কারণেই প্রতিষ্ঠানের এই দশা এদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি কি করব অধ্যক্ষকে বলেন। আমি তো প্রতিষ্ঠানটিতে তেমন সময় দেই না। সভাপতি হিসেবে যতটুকু করার ততটুকু করি।
আরও পড়ুনঃ
- অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ৩০ অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে!
- মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার এক মাস পার হলেও এমপিও বাতিল হয়নি অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের
- অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরতে দুই মাসেও অগ্রগতি নেই
- আর কে চৌধুরী কলেজ: তিন শিক্ষকের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার!