স্যার কেন বলব?

হাচিব মোহাম্মদ তুষারঃ স্যার নিয়ে চলমান বিতর্কে শত চেষ্টা করেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। ছাত্রজীবনে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুবাদে লেখালেখির অভ্যাসটি দীর্ঘদিনের। তবে আগে যেমন পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে লিখতে পারতাম, এখন সেখানে বাধ সেজেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর খড়্গ। প্রতিটি বাক্য লিখতে গেলে বারবারই বাধাগ্রস্ত হই। এই বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করা অনেক কঠিন। তারপরও আর কত চুপ থাকা যায়। একসময়ের নিজের তেজদীপ্ত লেখাগুলো যখন পড়ি তখন মনে হয় আর চুপ থাকা নয় এবার শক্ত হাতে কলম ধরতে হবে, সাধারণ মানুষের কল্যাণে কথা বলতে হবে, ভাগ্যে যা আছে হবে।

যাই হোক, এবার একটু মূল বিষয় কর্ণপাত করি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক ও বগুড়ার ডিসি মহোদয় এর মধ্যে চলমান স্যার বিতর্ক আজ আমাদের চরমভাবে হতাশ করছে। সারাবিশ্ব যেখানে নিত্যনতুন আবিষ্কার নিয়ে ব্যস্ত সেখানে আমরা সামান্য একটি বিষয় নিয়ে এমনভাবে ঝড় তুলছি যেন এটাতে যে পক্ষ জিতবে তার বদৌলতে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে অনেক সম্মানের জায়গায় পৌঁছে যাবে। আসলে জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে একটি জিনিস এখনও বিদ্যমান আর তা হলো ভাব বা আভিজাত্য। দেশের জন্য কিছু করি বা না করি, বিশ্বের দরবারে নিজের দেশকে উঁচু জায়গায় দাঁড় করাতে ভূমিকা রাখতে পারি বা না পারি নিজেকে জাহির করতে আমরা সদা সর্বদা ব্যস্ত।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাউকেই স্যার ঢাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এটা চিরসত্য বরং রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে জনগণ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। এমনকি জনগণ তাদের স্যার ডাকার দাবি করলেও অযৌক্তিক হবে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জেলা প্রশাসক দুজনই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী সুতরাং কারোই স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার আইনগত কোনো ভিত্তি নাই। তবে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী হিসেবে তার সম্মান সর্বজনবিদিত। আমার দৃষ্টিতে ডিসি মহোদয়ের স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার মানসিকতা বেরোবির শিক্ষক মহোদয় এর কোনো সহকর্মীর অতিশয় তোষামদির কারণেও তৈরি হতে পারে। সাংবাদিকতা ও চাকরির সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছ থেকে দেখার সুয়োগ হয়েছে।

আমার দেখামতে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ও দপ্তরে তার থেকে নি্মমানের কর্মচারীদেরও হরহামেশা স্যার ডাকতে দ্বিধা করছেন না যা অপ্রত্যাশিত। তৎপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ যখন বুঝতে পারছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম তখন তার মনে আভিজাত্যবোধ এমনভাবে বাসা বেঁধেছে যে ‘মুই কি হনুরে’।
কোনোভাবই তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। বগুড়ার জেলা প্রশাসক মহোদয়ের আচরণ হয়তো তার মনে গেঁথে যাওয়া আভিজাত্যবোধেরই বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশে সরকারি পর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। একজন ব্যক্তির বিদেশ সফর যে কেবল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জন এমনটি নয়। আমার জানামতে প্রতিটি প্রশিক্ষণের শুরুতে অথবা শেষে সে দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। উন্নত দেশের সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করে তার ভালোদিকগুলো নিজ দেশের মধ্যে প্রচলনের চেষ্টা করাও একজন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর দায়িত্বের অংশ। কিন্তু বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়েও যদি মানসিকতার কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে সেই প্রশিক্ষণের নামে জনগণের ট্যাক্সের লাখো টাকা ব্যয় করে লাভ কি?

পড়াশুনার সুবাদে বিশ্বের কিছু উন্নত দেশে ঘোরাঘুরি এবং উন্নত দেশের মানুষদের সাথে থাকার সুযোগ হয়েছে। তাদের আচরণ এতটাই মনোমুগ্ধকর যে আমার কাছে মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা তাদের উন্নত মানসিকতার জন্যই আজ সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। কে শিক্ষক, কে ডিসি, কে বড় কর্মকর্তা তার থেকেও তাদের বিবেচ্য সবাই মানুষ। তাই বলে তাদের পারস্পরিক সম্মানবোধ এর বিন্দুমাত্র ঘাটতি নাই। স্যার শুধুমাত্র একটি ডাকমাত্র আর এই ডাকটি জোর করে শুনতে চাওয়া আবার স্যার না ডাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিছক ছোট মানসিকতার পরিচয় যা আমাদের সমাজের দুজন সম্মানিত ব্যক্তির কারো কাছ থেকে কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা সাধারণ জনগণ সম্মানিতদের সম্মান দিতে চাই কিন্তু সম্মানিতদের নিজেদের মধ্যে কাদাছোড়াছুড়িতে যদি কোনোভাবেই আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটায় তাহলে তা হবে সকলের জন্যই অসম্মানের।

লেখক: আইনবিদ ও ডক্টরাল রিচার্স ফেলো, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/০৩/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়