মাদ্রাসা শিক্ষার মান উন্নয়নে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কতটা যৌক্তিক ?
।।ফিরোজ আলম।।
মানসম্পন্ন আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা মাদ্রাসার জন্য আজ সময়ের দাবি। কারন যোগ্য ও দক্ষতা সম্পন্ন জনবল তৈরি করতে মাদ্রাসা শিক্ষায় মান উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বলে মান উন্নয়নের নামে ভিত্তিহীন, অগ্রহনযোগ্য সিদ্ধান্ত মাদ্রাসার শিক্ষকরা মেনে নিবেনা।
গত ৪ ই মার্চ বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে আ, স, ম, ফিরোজের সভাপতিত্বে
অনুষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির বৈঠকে মাদ্রাসা শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে মাদ্রাসার বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষার বাংলা, গণিত এবং ইংরেজি বিষয়ের খাতা অন্য শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ শিক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
এটির কারন হিসেবে সংসদীয় কমিটির সভাপতির যুক্তি হচ্ছে ,মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সরকার অনেক টাকা খরচ করে কিন্তু কাঙ্খিত ফল দেখা যাচ্ছে না।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুনগতমান প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত হয় না। আলিয়া মাধ্যম থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভূমিকা রাখতে পারেনা । এ কারণেই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাখিল শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের খাতা অন্য কোন মাধ্যমের শিক্ষকদের মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এটা করা সম্ভব হলে নাকি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা চাপ থাকবে এবং তারা নিজেদের গুণগত মান উন্নত করার চেষ্টা করবে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতির এমন বক্তব্য মাদ্রাসার সকল শিক্ষক বিশেষ করে গনিত, বাংলা এবং ইংরেজি শিক্ষকদের জন্য অপমান জনক এবং ভিত্তিহীন।কারন1• যারা ক্লাশে উক্ত বিষয় সমূহে পাঠদান করেন তারা সকলেই স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের ন্যায় একজন জেনারেল শিক্ষক।
2•মাদ্রাসায় পাবলিক পরীক্ষার নিয়ম হল জেনারেল বিষয়ের পরীক্ষার দিন গার্ডে থাকবেন এরাবিক শিক্ষকরা এবং আরবি বিষয় সমূহের দিন গার্ডে থাকবেন জেনারেল শিক্ষকরা অথচ স্কুলে জেনারেল শিক্ষক জেনারেল বিষয়ের দিনই গার্ডে থাকেন।
3•প্রত্যক পাবলিক পরিক্ষার সময় ফুল টাইম সরকারি অফিসার যেমনি থাকে তেমনি থাকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা।
কাজেই সংসদীয় কমিটির অভিযোগ সত্য হলে বুঝতে হবে ক•এনটিআরসি অযোগ্য এবং তারা অযোগ্য শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় খ• মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মাদ্রাসার কাগজ মূল্যায়ন করলে যদি স্বজন প্রীতি থাকে ,তাহলে কি স্কুলের শিক্ষক স্কুলের খাতা মূল্যায়ন করলে সেখানে স্বজন প্রীতি থাকবেনা?
এটির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটি একদিকে স্কুল - কলেজ শিক্ষকদের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষকদের দ্বন্ধ তৈরির পথ তৈরি করছেন অন্যদিকে স্কুলের শিক্ষকদেরকে ও একই দোষে পরোক্ষ ভাবে দোষী সাব্যস্ত করছেন।গ• পরীক্ষার সময় ম্যাজিস্ট্রেট থেকে অন্যান্য কর্মকর্তা থাকার পর ও যদি মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রতি অসচ্ছতার অভিযোগ উঠে, তাহলে কি ধরে নিব পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত অফিসারগন সৎ নন? কিংবা এতকাল খাতা মূল্যায়নের প্রক্রিয়া সঠিক না হলে ও মাদ্রাসা বোর্ড তা বৈধ করেছেন? এখানে মাদ্রাসা বোর্ডকে ও কলংকিত করা হয়েছে।
ঘ•উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে কি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ন পদে অবদান রাখবেই এমন নিশ্চয়তা কি তিনি দিতে পারবেন?
তাই বলব ,যদি উক্ত প্রক্রিয়া চালু করতে হয় তাহলে স্কুলের খাতা ও মাদ্রাসার জেনারেল শিক্ষকরা মূল্যায়ন করবে এমন নীতি বহাল রাখতে হবে।
তিনি আরো বলেছেন,মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক পরীক্ষকরা নিজেদের চাকরির স্বার্থে শিক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দেন। এটা হলে এই সুযোগ তারা পাবে না।
তাহলে তাঁর প্রতি প্রশ্ন প্রতি বছর ২০% থেকে ২৫% মাদ্রাসা শিক্ষার্থী পাবলিক পরিক্ষায় ফেল করে ।যদি মাদ্রাসার পরিক্ষকরা এই জঘন্য অন্যায় কাজটি সত্যিই করতেন তাহলে এত বছর ধরে পাবলিক পরিক্ষায় এত শিক্ষার্থী ফেল করল কিভাবে? অথবা
গত এক যুগ ধরে ঢাবি,জবি,জাবি সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা প্রতি বারেই ভর্তি পরিক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয়
স্থান সহ সেরা কিভাবে হয়?
কাজেই বলব মাদ্রাসা শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি দরকার সন্দেহ নাই। কিন্তু মানোন্নয়নের জন্য করনীয় বাদ দিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রতি এই ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত মাদ্রাসার শিক্ষকরা মেনে নিবে না।
মনে রাখতে হবে,ব্রিটিশদের হাতে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মাদ্রাসাই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মওলানা ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের মতো সূর্যসন্তান তৈরি হয়েছিলেন মাদ্রাসা থেকেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। বাবা মৌলভি মো. ইয়াসিন খান সাহেবের কাছে গ্রহণ করা দ্বীনি শিক্ষাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কোরানে হাফেজ তাজউদ্দীন আহমদের বুনিয়াদ। স্মরন রাখা জরুরি বৃটিশরা ভারতে এসে প্রথম যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিল, সেগুলোর অন্যতম ছিল মাদ্রাসা বন্ধ করা। মাদ্রাসা বন্ধ হয়নি, কিন্তু ব্রিটিশদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
মানোন্নয়ন কি:
মান - এটির ইংরেজি শব্দ Standard । মানে হল বিচারের মাপকাঠি বা মান দন্ড। মানকে গুন হিসেবে ও চিহ্নিত করা যায়।আর উন্নয়ন এটির ইংরেজি শব্দ Development মানে হল উন্নয়ন বা অগ্রগতি। তার মানে মান উন্নয়নের এক সাথে অর্থ দাঁড়ায় উন্নয়ন বা অগ্রগতির মাপকাঠি।
এক কথায়, কোন ব্যক্তি, বস্তু, পণ্য, ঘটনা, ফলাফল ইত্যাদির কাঙ্ক্ষিত অবস্থাকে মানোন্নয়ন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। সুতারাং মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি মাদ্রাসায় যে শিক্ষা দেওয়া হয় সে শিক্ষা থেকে প্রত্যাশিত ফলাফল কতটুকু তার অগ্রগতি নির্ণয় করা।
শিক্ষার মান সাধারনত ২টি ভাবে নির্ণয় করা যায়।
(ক) শিক্ষার পরিমাণগত মান
(খ) শিক্ষার গুণগত মান।
(ক) শিক্ষার পরিমাণগত মান কেবল সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা হয়। যেমন- প্রতি বছর বাংলাদেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে A+ কিংবা A গ্রেড
কত জন পেল কিংবা পাশের হার কেমন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটির হিসাব নিরুপন করা।
(খ) শিক্ষার গুণগত মান বলতে A+ কিংবা A গ্রেড
এবং পাশের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার্থীরা কতটুকু মান সম্পন্ন শিক্ষা অর্জন করতে পারল সেটি নিরুপন করা। যে স্তর শেষে যে যোগ্যতা অর্জন করার কথা, তা কতটুকু অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে, এখানে তা মূখ্য।
মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে যা দরকার এক নজরে দেখে নিন:
1•সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণ: সর্বজনীন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আবার নাগরিকদের কর্তব্য হলো নিজের এই শিক্ষা গ্রহণ করা। এজন্য শিক্ষার পরিমাণগত বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন।
2•তথ্য প্রযুক্তি গত শিক্ষা নিশ্চিতকরন:
তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির যুগে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দক্ষতা অর্জনের বিক্ল্প নেই।
আর এই দক্ষতা-যোগ্যতা নিশ্চিত করতে মানসম্পন্ন শিক্ষাই অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে।
3• সরকারি হিসেব মতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হয় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শেষ করতে তার ৫২% ই ঝরে পড়ে।যতটুকু টিকে থাকে তাতে A+কিংবা পাশের হার বাড়লে ও মান বাড়ছেনা।
অথচ এখানে শতভাগ সরকারি সুবিধা বিদ্যমান।অন্যদিকে প্রাথমিকের তুলনায় মাদ্রাসার ইবতেদায়ী যেমনি জাতীয়করনের আওতা ভুক্ত নয় তেমনি সুযোগ সুবিধা নাই বললেই চলে।অথচ এখানে ঝরে পড়ার পরিমান ৪২%। তাই মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নে ইবতেদায়ী জাতীয়করন হতেই হবে।
4• মাদ্রাসা শিক্ষায় বাজেট টাকার অংকে নয়, আনুপাতিক হারে অধিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা।
5• মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়নে ২০২০/২১ অর্থ বছরে যেভাবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটি চলমান রাখা।
6•জনবল কাঠামো অনুযায়ী দ্রুত দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং তাদের সন্মানজনক বেতন স্কেল নিশ্চিত করা।
7• মাদ্রাসা শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
8• মাদ্রাসায় পড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই গরীব ।তাই শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা এবং মেধার ভিত্তিতে অধিক বৃত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
9• মাদ্রাসার বেশির ভাগ নারী শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকের আগে, অনেকে আবার মাধ্যমিকের পরপরই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়। তাই ১৮ বছরের আগে বিয়ে বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা কার্যকর করা।
10• অনেক মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কুসংস্কার কিংবা ধর্মীয় গোড়ামির জন্য আনন্দ দায়ক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।তাদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা আনন্দ দায়ক করে তুলতে হবে।
11•মাদ্রাসা জাতীয়করন চালু করতেই হবে:
গত এক যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরিক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় পাওয়া যায়।উদাহরন স্বরুপ ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ৯.৯৮ হওয়া সত্ত্বেও ‘ঘ’ ইউনিটে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম হন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন। একই ইউনিটে মানবিক শাখা থেকেও প্রথম হন আরেক মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুস সামাদ। ‘খ’ ইউনিটে দ্বিতীয় হন মাদ্রাসা ছাত্র মো. রিজাত হোসেন। ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষেও ঢাবির ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় শীর্ষস্থানটি মাদ্রাসা ছাত্রের দখলেই। তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুল্লাহ মজুমদার মেধাতালিকায় প্রথম হন। পাসের হার যেখানে মাত্র ১১.৪৩ শতাংশ, সেখানে একজন মাদ্রাসা ছাত্র প্রথম হওয়ার পরও শুধু ‘মাদ্রাসা ছাত্ররা দূর্বল এটি চিহ্নিত করা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশে সরকারি মাদ্রাসা মাত্র তিনটি। এর বাইরে উচ্চশিক্ষায় ২১৫টি কামিল, ৭৭টি ফাজিল (অনার্স) এবং এক হাজার ৯৭ টি ফাজিল (পাস) মাদ্রাসা রয়েছে।
মাদ্রাসার ছাত্ররা এত সফলতার স্বাক্ষর রাখার পরও বাংলাদেশে তিন শতাধিক কলেজ এবং দুই শতাধিক স্কুল জাতীয়করণ করা হলেও সরকারি মাদ্রাসার সংখ্যাটি তিনটিতেই থেকে যাচ্ছে কিছু অদৃশ্য শক্তির চক্রান্তের কারনে। সর্বশেষ তথ্য মতে ৩০২ টি কলেজ জাতীয়করণ করা হলেও একটি মাদ্রাসাও জাতীয়করণ করা হয়নি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি, এমন কলেজ জাতীয়করণ হওয়া সত্ত্বেও পাসের হার ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আকাশচুম্বী সাফল্যের স্বাক্ষর রাখার পরও জাতীয়করণের তালিকায় একটি মাদ্রাসার নাম না থাকা মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিন্ম গামী করার চক্রান্ত বৈ আর কি ভাবে চিন্তা করা যায়?
12•মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া:
মাদ্রাসা শিক্ষা আজ অনেকটা চার দেওয়ালে বন্দি।মাদ্রাসা ছাত্রদের বর্তমানে অবস্থা হল এই যে পাস করলে সরকারি চাকুরি তাদের জন্য স্বপ্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৫% ই হল এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা। অথচ মোট সরকারি চাকরির বাজারে ১০% ও মাদ্রাসা থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের দখলে নাই।যে ১০% মাদ্রাসা থেকে পাস করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশই আলিম তথা এইচ এস সি পাসের পর কোন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে থেকে স্নাতক নিয়ে ঐ সরকারি চাকুরিতে প্রবেশ করছে।প্রতি বছর আলিম পাসের পর জিপিএ ৪ থেকে ৫ পর্যন্ত পাওয়া মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ছুটছে নামী দামী কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ফলে মেধাশূণ্য হচ্ছে আলিম/ফাজিল/কামিল মাদ্রাসা।কেন মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা মাদ্রাসাতে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা থাকার পরও মাদ্রাসা ছেড়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটছে? তাহলে কি মাদ্রাসাতে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা নাই? নাকি মানহীন লোক দেখানো উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে? এবার আলোচনা করা যাক উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কি বুঝি।অক্সফোর্ড, হার্ভাড,ক্যমব্রিজ,আল আজহার,মদিনা,মক্কা,সহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সমুহের তথ্য মতে উচ্চ শিক্ষা বলতে বোঝায় নতুন জ্ঞানের সৃজন ও প্রশিক্ষন এবং গবেষনার মাধ্যমে জ্ঞানের সীমারেখাকে ক্রমাগত বিস্তৃত করা।তার মানে যেখানেই উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা আছে সেখানেই যত বিষয় পাঠদান হবে তাতে নতুন জ্ঞানের সৃজন,প্রশিক্ষন এবং গবেষনার পথ থাকতে হবে।তাহলে মাদ্রাসার উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ফাজিল অনার্স/ডিগ্রি কিংবা কামিলের যত বাংলা, আরবি, ইংরেজী বিষয় থাকবে তাতে সৃজনশীল এবং গবেষনাধর্মী জ্ঞান প্রসারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।যত সেমিনার হবে তাতে প্রশিক্ষনে জেনারেল ও এ্যারাবিক শিক্ষক উভয়ের অংশ গ্রহন থাকতে হবে।অথচ এগুলির খুব কম প্রয়োগ থাকার কারনেই মাদ্রাসার মান ও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকির মুখে।
মাদ্রাসা শিক্ষার মান উন্নয়ন ও মাদ্রাসাতে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যা দরকার তা হল:
ক• আলিয়া মাদ্রাসাগুলি যেহেতু এ্যারাবিক ও নন এ্যারাবিক দুইয়ের সমন্বয়ে পরিচালিত এবং এখানে উভয়ের কার্যক্রম মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। তাই আরবি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বোর্ডে আরবি শিক্ষিত ও জেনারেলদেরকে সমহারে পদায়ন করতে হবে।কারন শুধু আরবি শিক্ষিতরা সিন্ডিকেট মেম্বার থাকলে মাদ্রাসার জেনারেল বিষয়গুলি পিছনে পড়বে।মাদ্রাসার উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হবে।
খ•আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়কে অন্যান্যদের কথায় কান না দিয়ে সরকারি নীতিমালা মোতাবেক আরবি বিষয়ের পাশাপাশি ইংরেজী ,বাংলা,আইসিটি,সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি সহ জেনারেল বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করতে হবে। যাতে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয়।
গ• দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া ডিগ্রি,অনার্স- মাস্টার্স এর মান প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।তাই প্রশাসনে আরবি শিক্ষিতদের পাশাপাশি জেনারেলদেরকে ও পদায়ন করতে হবে।কারন প্রশাসন চালাতে আরবির কোন প্রয়োজন নাই।অন্যদিকে ক্লাশে বিষয়ভিত্তিক পাঠদান আর প্রশাসন চালানো সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস।আর যারা প্রশাসন পরিচালনা করেন তারা নিজের মনগড়া নয় বরং নীতিমালা অনুসরন করেই প্রশাসন পরিচালনা করেন।
ঘ• দক্ষ ও গুনগত মান সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ নিয়োগ দান করা।
ঙ• প্রয়োজনীয় ভৌত অব কাঠামোর বন্দোবস্ত করা।চ• উচ্চ শিক্ষাখাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বরাদ্দ বাড়ানো।
ছ• প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করতে হবে।বিশ্লেষণধর্মী ও সকল অধ্যায়ের সংমিশ্রণে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে হবে।আগের বছরের প্রশ্নের টপিক পরের বছরে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।এতে নোট ও ফটোকপির উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে।শিক্ষার্থীর গবেষনাধর্মী লেখাপড়া বৃদ্ধি পাবে।
জ• শিক্ষকদের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাকল্পে ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
ঝ• মাদ্রাসাতে এমপিল ও পিএইচডি ডিগ্রি চালু করতে হবে।
ঞ• গ্রন্থাকার কে গ্রন্থ ও জার্নালে সমৃদ্ধশালী করতে হবে।
ট• নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে একটি সৃজনশীল উচ্চশিক্ষিত কর্মি বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সিঙ্গাপুরের মত Learning to think and thinking to learn এর ভিত্তিতে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে।
ঠ• তথ্য প্রযক্তি বিষয়ক স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ড• মাদ্রাসাতে চাকুরি উপযোগী কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষা চালু করতে হবে।
ঢ•শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন অসম্ভব।তাই মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করন করা অতীব জরুরি ।
ণ•সার্টিফিকেট সর্বস্ব মূল্যায়ন উঠিয়ে দিয়ে কে কত জ্ঞানী তা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
ত• আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৯ এর ৭ পৃষ্ঠার ২.১অনুচ্ছেদ মতে মাদ্রাসায় ক্লাস ওয়ান থেকে আলিম পাস করার পর আরবি বিশ্ববিদ্যালয় চালুকৃত ইস: ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় সহ অন্য বিষয়ে ৪+১ বছর অনার্স-মাস্টার্স পাস করা মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরাই মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদে আবেদন করতে পারবেনা।অথচ সাধারন কামিল ও সাধারন ডিগ্রি নিয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যরা মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদে আবেদন করতে পারবে। এটি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১),২৮(১),২৮(৩),২৯(১),২৯(২) অনুচ্ছেদ পরিপন্থী। তাই আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রবিধান ২০১৯ এ বৈষম্য প্রথা বাতিল করতে হবে।
থ• মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা এনটিআরসি এর নিয়োগ পরিক্ষায় গনিত, ইংরেজী,তথ্যপ্রযুক্তি সহ অনেক জেনারেল বিষয়ে ফেল করার কারনে নিবন্ধন পরিক্ষায় কাঙ্খিত সংখ্যক ছাত্রছাত্রীরা পাশ করতে পারেনা ।আরবির পাশাপাশি জেনারেল বিষয়কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
দ• মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মহোদয় গন ক্যাশের ভাউচার নিজের হাতে লিখার চেষ্টা করেন, অধ্যক্ষদের এই গৌন কাজ বাদ দিয়ে নিজ কাজে মনোযোগ দিতে হবে।
ধ• মাদ্রাসা শিক্ষা,শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দের মাঝে নেগেটিভ চিন্তা- ভাবনা দূর করতে এবং স্বাধীনতাত্তোর দেশের জনগোষ্ঠীকে একই কাতারে শামিল করে একটি অভিন্ন মানব চেতনা ও জাতীয় চেতনা উদ্ধুদ্ধ করতে মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সংগ্রামের প্রতি পর্বের কৃতিত্বপূর্ন বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ন• আরবি ভাষার প্রতি জোর দিতে হবে এবং প্রত্যেক মাদ্রাসায় এ্যারাবিক ল্যাংগুয়েজ ক্লাব চালু করতে হবে।
প• বাংলাদেশে মাদ্রাসায় ছাত্র ও ছাত্রী প্রায় সমান। তাই মাদ্রাসায় নারী শিক্ষিকা নিয়োগ বাড়াতে হবে।ফ• মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের মাদ্রাসার প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দান বন্ধ রাখতে হবে।
তাই পরিশেষে বলব, মাদ্রাসা শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়ন অবশ্যই দরকার।কিন্তু মানোন্নয়নের সঠিক রাস্তা বাদ দিয়ে ভিত্তিহীন সুপারিশ তুলে নিতে সংসদীয় কমিটির সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।