ভোগান্তির আরেক নাম অনলাইন জন্মনিবন্ধন ও সংশোধন
আপনার যদি ১৭ ডিজিটের জন্ম নিবন্ধন সনদ না থাকে, তাহলে সেটি পেতে আপনাকে একটি জটিল ও ঝামেলাপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং তার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। বর্তমানে প্রায় ১৮টি নাগরিক সেবা পেতে এ সনদ আবশ্যক। তাই নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করা এখন খুবই জরুরি।
শারমিন বলেন, 'কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাড়া আমার মেয়েকে ভর্তি করবে না। এখন আমি আর আমার স্বামী নিজেদের জন্ম নিবন্ধন সনদ জোগাড়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। মেয়ের সনদ পেতে আগে আমাদেরটা লাগবে।'
এছাড়াও, ১২ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী শিশুদের করোনাভাইরাস টিকা পেতেও ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়।
ডেলিভারি রশিদে বলা হয়, প্রয়োজনীয় নথি জমা দেওয়ার ১৫ দিন পর সনদ দেওয়া হবে। কিন্তু এ সনদ পেতে ১ মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে অনেককে।
যেমন, রায়েরবাজার বস্তির বাসিন্দা রিকশা চালক আবদুল গফুর সনদের জন্য আবেদন করতে পারেননি। কারণ সিটি করপোরেশনের কর্মীরা 'বস্তি এলাকা'কে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে মেনে নিতে রাজি হননি।
তিনি জানান, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত তার গ্রামটি দীর্ঘদিন আগে ব্রক্ষপুত্র নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে।
বানেছা বেগম নাগরিকত্ব সনদ জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু সেখানে স্বামীর নাম লেখা না থাকার কারণ দেখিয়ে তার আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী তৌহিদ উর রহমান তার মেয়ের জন্মতারিখ সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গত মাসে কর্মকর্তারা তাকে জানান, সে মুহূর্তে সার্ভারে সংশোধনের প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। তারপর তিনি ঢাকা জেলা কমিশনারের কার্যালয়ে একটি আবেদন জমা দিয়ে জানান যে তার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন বাতিল করতে চান এবং নতুন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র জমা দেওয়ার কথাও জানান।
ডেলিভারির দিন শাহাদাত দেখেন, মুদ্রিত সনদে তার মায়ের নামের বানান ভুল। যদিও অনলাইনে বানান ঠিক ছিল।
তিনি বলেন, 'আমার ধারণা তারা ইচ্ছা করেই বানান ভুল করেছেন, কারণ আমরা দালালের সহায়তা না নিয়ে নিজেরাই আবেদন করেছিলাম। এখন আমাদের এই নামগুলো সংশোধন করার জন্য ঝামেলা পোহাতে হবে।'
ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও নলছিটি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক বিন-ই-আমিন জানান,২০১৩ সালে আমার স্ত্রী ও ২ সন্তানের জন্মসনদ অনলাইন করতে দেই। তখন পৌরসভার মাস্টার রোলে সুইপার পদে চাকরি নেওয়া শিক্ষিত যুবক( ছদ্ম নাম হাসান)'র মাধ্যমে ইংরেজিতে জন্মসনদ বের করি। ২০২১ সালে জরুরি প্রয়োজনে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ২০১৩ সালের যেই ইংরেজিতে করা জন্মনিবন্ধন পৌরসভা থেকে দেওয়া হয়েছিল আসলে সেসব জন্মনিবন্ধনের তথ্য অনলাইনে নেই।
শিক্ষক বিন-ই-আমিন জানান, শুধু আমার ছেলের জন্মনিবন্ধন অনলাইনে পাওয়া গেলেও ছেলের নামে শেষ অংশ ও পিতার নামের শেষ অংশে ভুল ছিল। তাছাড়া ইংরেজিতে কোনো তথ্য অনলাইনে ছিলোনা। স্ত্রী ও মেয়ের কোনো তথ্যের সাথে জন্মনিবন্ধনের নাম্বারে মিল নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌরসভার কর্মচারী হাসান(ছদ্ননাম) কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কম্পিউটার অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কম্পিউটার অপারেটর জানান,আবার নতুন করে আবেদন করে কয়েকধাপে ডিসি অফিসে শুনানির পর কাগজ সংশোধন হয়ে আসবে। উপায়ান্তর না পেয়ে শিক্ষক বিন-ই-আমিন কম্পিউটার অপারেটরের কথা মতো পৌরসভা থেকে যথাযথ নিয়মে দরখাস্ত করে ঝালকাঠি ডিসি অফিসে যাওয়া আসা চালায়। ২০২১ সালের জুন মাসে শুনানি হলেও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে এসেও সন্তানদের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সংশোধন হয়ে আসেনি।
এদিকে ছেলের ইউনিক আইডির প্রয়োজনে অনলাইন জন্মনিবন্ধন প্রয়োজন হলে তিনি আবার ঝালকাঠি ডিসি অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানান, নলছিটি পৌরসভা থেকে ফরোয়ার্ড করতে হবে কাগজ। পুনরায় নলছিটি পৌরসভায় গেলে তারাও জানান,কাগজ ফরোয়ার্ড করা হয়েছে কিন্তু কেনো যে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। দুর্ণীতি,অসদাচরণ ও অনিয়মের দায়ে হাসান ও কম্পিউটার অপারেটর সহ কয়েকজনকে বরখাস্ত করে পৌর কর্তৃপক্ষ। এখন পার্ট টাইমে যে ছেলেটি কাজ করছে সে সঠিক কোনো সমাধান ও তথ্য দিতে না পারায় বিপাকে পড়েন বিন-ই-আমিন এর মতো অনেক ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
বিন-ই-আমিন জানান,আমি শহরের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। পাশাপাশি সাংবাদিকতার খাতিরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। জেলা প্রশাসকও আমার ব্যাপারে অবগত। আমার সন্তানদের ও স্ত্রীর জন্মনিবন্ধন সংশোধন কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং সহকারী কমিশনার ভূমিও জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলেন। তারপরও ৬ মাসেও আমার কাগজপত্র সংশোধন না হওয়া পরিতাপের বিষয়। জেলার সাধারণ শাখায় জন্মনিবন্ধন সংশোধন কাজে নিয়োজিত অফিস কর্মচারীদের টাকার বিনিময়ে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও করেন শিক্ষক বিন-ই-আমিন। তিনি জানান,আমি এক পয়সাও অবৈধ লেনদেন করবোনা। তিনি আরো বলেন,নলছিটি পৌরসভার শতকরা ৯০ ভাগ লোকের জন্মনিবন্ধনে কোনো না কোনো ভুল রয়ে গেছে। কম্পিউটার অপারেটর ( বর্তমানে বরখাস্ত) এর সাথে কথা বললেও তিনি কারো সাথে সদাচরণ করেন না। তিনি জানান, তার( অপারেটর) বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া যাবে তদন্ত করলে।
তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে গ্রাহকদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।'
সাবেক ও সর্বশেষ রেজিস্ট্রার জেনারেল মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী ডেইলি স্টারকে জানান, তারা প্রতিদিন অন্তত ১ লাখ জন্ম নিবন্ধনের আবেদন পাচ্ছিলেন।
'আমরা এই প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে এর সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছাবে।
অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি জানান, যেহেতু আবেদন অনলাইনে করা হয় এবং মানুষকে কিছু কাগজ জমা দিতে হয়, এ ক্ষেত্রে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।