ইসলামে বিবাহ ও তার সুন্নাহ পদ্ধতি
মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ।।
মানব জীবনে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মহান আল্লাহ তাআলার এক বিশেষ নেয়ামত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। ঈমানের পূর্ণতার সহায়ক। চারিত্রিক আত্মরক্ষার অনুপম হাতিয়ার। বিয়ে যুবক-যুবতীর চরিত্র গঠনের অন্যতম উপাদান এবং এটি মানুষকে দায়িত্ববান বানায়। আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ হচ্ছে বিবাহ। যা প্রত্যেক মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা। এ চাহিদা পূরণার্থেই ইসলামি শারিআত বিয়ের হুকুম আরোপ করেছে।
মানবজাতিকে লিভ-টুগেদারের মতো মহাঅভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে যৌন চাহিদা পূরণের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং একটি মহান ইবাদতও বটে। বিবাহ দ্বারা ইহ ও পরকালীন কল্যাণ সাধিত হয়। বিবাহ মানুষের জীবনকে পরিশীলিত, মার্জিত এবং পবিত্র করে তোলে। আদর্শ পরিবার গঠন, জৈবিক চাহিদা পূরণ, মানসিক প্রশান্তি ও মানব বংশ বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হলোবিবাহ। সুতরাং বলাবাহুল্য যে, বিয়ে করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। অতএব, কেউ যখন বিয়ে করবেন তার উচিত বিয়ের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা অর্জন করা।
বিবাহের গুরুত্ব
মহান আল্লাহ পৃথিবীর সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন (যারিয়াত ৫১/৪৯)। এমনকি লতা-পাতা, গাছ-পালাও (ইয়াসীন ৩৬/৩৬)। তেমনি মহান আল্লাহ মানুষকে নারী-পুরুষে বিভক্ত করেছেন (হুজুরাত ৪৯/১৩, নিসা ৪/১) এবং একে অপরের প্রতি আকর্ষণীয় করে দিয়েছেন। ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, বসবাস ও জৈবিক চাহিদা পূরণের একমাত্র পন্থা হিসাবে বিবাহের প্রচলন করা হয়েছে। এজন্য প্রত্যেক অভিভাবককে তাদের অধীনস্থদের বিবাহের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্বামীহীন তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও’ (নূর ২৪/৩২)।
বিবাহের মাধ্যমে মানুষ তার দৃষ্টিকে সংযত করে যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষার মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম করতে সক্ষম হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিবাহ করা কর্তব্য। কেননা বিবাহয় দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন ছিয়াম পালন করে। কেননা ছিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম’।[বুখারী/৫০৬৫; মুসলিম/১৪০০; মিশকাত/৩০৮০ ‘নিকাহ’ অধ্যায়; বুলূগুল মারাম হা/৯৬৮] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা স্নেহপরায়ণ বেশী সন্তান জন্ম দানকারিণীকে বিবাহ কর। কেননা আমি বেশী উম্মত নিয়ে (ক্বিয়ামতের দিন) গর্ব করব’।(আবূদাউদ হা/২০৫০; নাসাঈ হা/৩২২৭; ইরওয়াউল গালীল হা/১৭৮৪; মিশকাত হা/৩১৯১]
বিবাহ করা সমস্ত নবীদের সুন্নাত। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পূর্বে আমরা অনেক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম এবং তাদেরকে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দিয়েছিলাম’ (রা‘দ ১৩/৩৮)। রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের নিকট আগত তিন ব্যক্তির এক ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করার স্বার্থে বিবাহ না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি নারীদেরকে বিবাহ করি (সুতরাং বিবাহ করা আমার সুন্নাত)। অতএব যে আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে সে আমার দলভুক্ত নয়’।[বুখারী হা/৫০৬৩; মসুলিম হা/১৪০১; মিশকাত হা/১৪৫ ‘ঈমান’ অধ্যায় ‘কিতাব ও সুন্নাহ আকড়ে ধরা অনুচ্ছেদ; বুলূগুল মারাম হা/৯৬৮ ]
বিবাহ না করে চিরকুমার ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি ইসলামে নেই। সা‘আদ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) ওছমান ইবনু মাযঊনকে নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের অনুমতি দেননি। তাকে অনুমতি দিলে আমরা নির্বীর্য হয়ে যেতাম’।(বুখারী হা/৫০৭৩; মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮১, ‘বিবাহ’ অধ্যায়] আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসূল (ছাঃ) নিঃসঙ্গ জীবন যাপনকে নিষেধ করেছেন’।[বুখারী হা/৫০৭৩; নাসাঈ হা/৩২১৩; মিশকাত হা/৩০৮১ ]
স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে বিবাহ না করার অনেক অপকারিতা রয়েছে। প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ আল্লামা নাফীসী বলেছেন, ‘শুক্র প্রবল হয়ে পড়লে অনেক সময় তা অত্যন্ত বিষাক্ত প্রকৃতি ধারণ করে। মন ও মগজের দিকে তা এক প্রকার অত্যন্ত খারাপ বিষাক্ত বাষ্প উত্থিত করে, যার ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়া বা মৃগী রোগ প্রভৃতি ধরনের ব্যাধি সৃষ্টি হয়’।[মাওলানা আবদুর রহীম, পরিবার ও পারিবারিক জীবন, (ঢাকা : খাইরুন প্রকাশনী, ২০০৫), পৃঃ ৮৫] শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থ হুজ্জতুল্লাহিল বালিগাহতে বলেছেন, ‘জেনে রাখ, শুক্রের প্রজনন ক্ষমতা যখন দেহে খুব বেশী হয়ে যায়, তখন তা বের হ’তে না পারলে মগজে তার বাষ্প উত্থিত হয়’।[তদেব, ৮৫]
বিবাহের মাধ্যমে বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়। মানুষ তার জৈবিক চাহিদা বিবাহ ব্যতীতও মিটাতে পারে; কিন্তু ইসলামে তা অবৈধ, হারাম। পক্ষান্তরে বিবাহের ব্যবস্থা না থাকলে বংশীয় ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মানুষের পরিচয় বিলীন হয়ে যাবে, একে অপরের প্রতি দয়া-মায়া কমে যাবে, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যাবে।
অনেকে দরিদ্র হওয়ার কারণে স্ত্রী-সন্তান লালন-পালন না করতে পারার ভয়ে বিবাহ করে না। অথচ আল্লাহ বিবাহের কারণে দরিদ্রকে সম্পদশালী করে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তারা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে সম্পদশালী করে দিবেন’ (নূর ২৪/৩২)। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোকের উপর আল্লাহর সাহায্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে- (১) যে দাস নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায়। (২) যে লোক বিবাহ করে নিজের নৈতিক পবিত্রতা রক্ষা করতে চায়। (৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদে যেতে চায়’।[নাসাঈ হা/৩২১৮, হাদীছ হাসান]
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহের বন্ধন আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিণীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া দান করেন’ (রূম ৩০/২১)। বিবাহের মাধ্যমেই সতীত্ব ও চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষা করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘স্ত্রীরা হচ্ছে তোমাদের জন্য পোষাক স্বরূপ, আর তোমরা তাদের জন্য পোষাক স্বরূপ’ (বাক্বারাহ ২/১৮৭)। যে সমাজে বিবাহ ব্যতীত অবাধে নারী-পুরুষের মেলামেশা চলে সেখানে পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয় এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। পরিশেষে অবৈধ মেলামেশার কারণে পরকালে এরা জাহান্নামের কঠিন আযাবের সম্মুখীন হবে।
বিবাহ করা দ্বীনের পূর্ণতা অর্জনের পরিচায়ক। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যখন কোন ব্যক্তি বিবাহ করল, তখন সে দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করল’।[বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৩০৯৬, সনদ হাসান] সুতরাং বিবাহ না করলে ব্যক্তি গোনাহগার না হ’লেও এতে শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে অগ্রাহ্য করা হয়। চলবে------
লেখক:
কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ