মাধ্যমিক শিক্ষায় নূতন চ্যালেঞ্জ
নিউজ ডেস্ক।।
বলা হয়, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। তবে যদি বলা হয়, কোন স্তর পর্যন্ত শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, তাহা হইলে অবশ্যই মাধ্যমিক শিক্ষার কথা চলিয়া আসে। মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জাতীয় চেতনা, জাতীয় প্রেক্ষাপট, সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করিবার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, স্বনির্ভরতা ইত্যাদি সম্পর্কেও তাহাদের এই পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
সাধারণত একটি জাতির ২০ শতাংশেরও কম মানুষের ভাগ্যে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকে। বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়া যদি সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত হয়, তাহা হইলেও একটি জাতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইয়া যাইতে পারে। এই জন্য মাধ্যমিক শিক্ষাকে আমাদের অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হইবে। অন্তত সবাই যাহাতে অষ্টম বা দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিতে পারে, তাহার সুব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে। কিন্তু আমাদের দেশে এই স্তরে আসিয়া শিক্ষার্থীর ঝরিয়া পড়িবার হার দেখিলে বিস্মিত হইতে হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে এই হার আরও বাড়িয়া চলিয়াছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, করোনা সংকটের কারণে ময়মনসিংহ জেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থী। ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। আরও উদ্বেগের বিষয় হইল, প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয় চেষ্টা করিয়াছে শিক্ষার্থীদের ফিরাইয়া আনিতে। কিন্তু চেষ্টা-চরিত্রের পরও কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসে নাই। শিক্ষাবর্ষ শেষ না হইতেই এই সকল শিক্ষার্থী ঝরিয়া পড়িয়াছে এবং শিক্ষাবর্ষ শেষ হইবার পর আরও কিছু শিক্ষার্থী ঝরিয়া পড়িবার আশঙ্কা করা হইতেছে। একটি জেলায় যদি এত শিক্ষার্থী ঝরিয়া পড়ে, তাহা হইলে সারা দেশে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরিয়া পড়িবার হার নিয়া আমরা উদ্বেগ প্রকাশ না করিয়া পারি না।
করোনা শুধু আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধস নামায় নাই, গত দেড় বৎসরে শিক্ষাব্যবস্থারও প্রভূত ক্ষতি সাধন করিয়াছে। বাল্যবিবাহ, পরিবারের অভাব-অনটন, শিক্ষার্থীদের বাধ্য হইয়া আয়-উপার্জনমূলক কাজে জড়িত হওয়া, করোনায় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকা, জীবনের অনিশ্চয়তা ও অনিরাপত্তা প্রভৃতি কারণে এই স্তরে শিক্ষার্থীরা ঝরিয়া পড়িতেছে। সবচাইতে বেশি ঝরিয়া পড়িতেছে সপ্তম শ্রেণিতে। আবার দশম শ্রেণিতে আসিয়াও অনেকে ঝরিয়া পড়িতেছে। যেমন, এইবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় মোট ২২ লক্ষ ২৭ হাজার ১১৩ জন পরীক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাহাদের মধ্যে ৭৮ হাজার ৬২৮ জনই পরীক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত হয় নাই। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কেবল তিনটি নৈর্বচনিক বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হইলেও এই বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হইতে প্রমাণিত হয়, করোনার অভিঘাতে এই স্তরে শিক্ষার্থী ঝরিয়া পড়িবার সমস্যা আরও বাড়িয়াছে।
২০১৯ সালে প্রাথমিক স্তরে ঝরিয়া পড়িবার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে আসিয়া ইহার হার যে অনেক বাড়িয়াছে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। উপরিউক্ত ময়মনসিংহ জেলার পরিস্থিতি দেখিয়া তাহা সহজেই অনুমেয়। করোনার বিপর্যয়ে দারিদ্র্য হার বৃদ্ধিই ইহার প্রধান কারণ। বিশেষ করিয়া শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরা বেশি ঝরিয়া পড়িতেছে বলিয়া খবর আসিতেছে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ হইতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হইবার পর অনলাইন ক্লাস, টেলিভিশন ক্লাস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হইলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা সেই সুবিধা পায় নাই। ফলে তাহাদের লেখাপড়ায় ছেদ ঘটিয়াছে। তাহাদের পড়ালেখা অব্যাহত রাখিবার ব্যবস্থা করা এখন চ্যালেঞ্জিং হইয়া পড়িয়াছে।
এই অবস্থায় আমাদের নূতন করিয়া করণীয় নির্ধারণ করিতে হইবে। প্রত্যেক বিদ্যালয় ঝরিয়া পড়া শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করিয়া শিক্ষকগণ ঘরে ঘরে যাইতে পারেন। পাড়া-মহল্লায় মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। অনেকে মনে করেন, স্কুল-কলেজে আপাতত নূতন বিল্ডিংয়ের দরকার নাই। আমাদের মোটামুটি শিক্ষা-অবকাঠামো রহিয়াছে। এখন বিল্ডিংয়ের টাকা দিয়া উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো যাইতে পারে। দরিদ্র পরিবারের প্রত্যেক সন্তান যেন এই উপবৃত্তি আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে পাইতে পারে, তাহার সুব্যবস্থা করা যায়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও সম্প্রসারণ করা যাইতে পারে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরিয়া রাখিতে শিক্ষাভীতি দূর করাসহ অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আজ জরুরি হইয়া পড়িয়াছে।ইত্তেফাক