কে হচ্ছেন পরবর্তী ভিসি
নিউজ ডেস্ক।।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বর্তমান উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২৪ মার্চ। আর ৭ মার্চ রবিবার মেয়াদ শেষ হচ্ছে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. সাহানা আখতার রহমানের। ফলে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন নিয়োগ নিয়ে মুখর এখন দেশের স্বাস্থ্য খাত; বিশেষ করে দেশের একমাত্র এই চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভিসি কে হচ্ছেন, সে আলোচনা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সরকার কি এই পদে নতুন নিয়োগ দেবে, নাকি বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানো হবে এমন আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে চিকিৎসা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে।
ভিসি ও প্রো-ভিসি পদে নিয়োগ পেতে জোর তদবিরও শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক চিকিৎসকরা নানাভাবে তদবির করছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও তদবির চলছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ে নানা তালিকাও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সরকারদলীয় সব চিকিৎসক নেতাই ভিসি হতে চান।
সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ভিসি পদ নিয়ে। বর্তমান উপাচার্যই দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন এমন কথা বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে সরকারদলীয় চিকিৎসক নেতাদের একপক্ষ বলছে, করোনার জন্য বর্তমান উপাচার্য ও তার প্রশাসন অনেক কাজ করতে পারেনি, অসমাপ্ত রয়ে গেছে। করোনা মোকাবিলায়ও এই উপাচার্যের অনেক কাজই বেশ প্রশংসিত হয়েছে; বিশেষ করে চলমান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সরকার ভিসি পরিবর্তনের মতো সিদ্ধান্ত না-ও নিতে পারে।
দলীয় চিকিৎসকদের অন্য পক্ষ মনে করছে, আওয়ামী লীগের মধ্যে দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা অনেক চিকিৎসক রয়েছেন। তারা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে পেশাজীবী রাজনীতি ও সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অনেক অবদান রেখেছেন। বর্তমান উপাচার্য তিন বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। তার বয়স হয়ে গেছে। অবসরে গেছেন। চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সভাপতি হয়েছেন। সবকিছুই তো পেয়েছেন। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী দলের ত্যাগ স্বীকার করা সবাইকে মূল্যায়ন করতে চান। সে কারণে একজনকে আর দ্বিতীয়বারের জন্য দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখন নতুনদের আনা উচিত।
অবশ্য উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) পদে নতুন নিয়োগ দেওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি বলে জানা গেছে। কারণ হিসেবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চিকিৎসক দেশ রূপান্তরকে জানান, বর্তমানে যিনি উপ-উপাচার্য তার বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরির মেয়াদ ৬৫ বছর হতে দুই বছরের কম আছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। মেয়াদ যেহেতু নেই, তাই আংশিক দেড় বছর বা পৌনে দুই বছরের জন্য তাকে আবার নিয়োগ দেওয়া হবে কি না, সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়।
ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগ এবং নতুন ভিসি পদে নিজের নাম শোনা যাচ্ছে এমন বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া গতকাল শুক্রবার রাতে দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি কী কাজ করলাম কিংবা কতটুকু ব্যর্থতা, সেই বিচার তো আমি করতে পারব না। ব্যর্থতা যদি কিছু থেকে থাকে, সে দায় সম্পূর্ণ আমার। করোনা আমাদের সংকুচিত করে দিয়েছে। বিদ্যমান লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়েই করোনা মোকাবিলায় আমাকে কাজ করতে হয়েছে। তারপরও সেটা সবার বিচারের বিষয়। তা ছাড়া সরকারের সব কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য যা করেছি, এসব গণমাধ্যম বন্ধুরা দেখবেন, জনগণ ও সরকার দেখবে।
এখনো করোনার কারণে অনেক কাজ আটকে আছে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সার্ভিস এটুআইয়ের (অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন) সঙ্গে যৌথভাবে অটোমেশনে যাওয়াটা বিলম্ব হয়ে গেল। পাশের যে বিশেষ হাসপাতাল সেটাও আট-নয় মাস দেরি হয়ে গেল। বিল্ডিং উঠে গেছে। ভেতরের কাজগুলো করতে সাত-আট-নয় মাস লাগবে। বেতার ভবনে যে ফিভার ক্লিনিক, সেখানে দুইটা ২০তলা ভবনের হাসপাতাল করার জন্য চার দিন আগে কোরিয়া থেকে দুইটা টিম এসেছিল। আউটডোর সার্ভিসে পাঁচতলা করে দুইটা বিল্ডিং উঠে গেছে ও ভেতরের কর্মকান্ড বাকি আছে। বৈকালিক সেবাটাও করোনার জন্য থেমে আছে। সুতরাং আমাকেই রাখবে, নাকি নতুন ভিসি নিয়োগ দেবে, সেটা সস্পূর্ণ সরকারের বিষয়।
উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) নিয়োগের ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ভিসির মতো প্রো-ভিসির মেয়াদও তিন বছর। নতুন নিয়োগের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায়। যথাযথ তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে উনি একজনকে নিয়োগ দেন। পরে তা রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে উপ-উপাচার্য নিয়োগ পান। সেটা প্রক্রিয়াধীন আছে। দুই-চার দিন দেরি হলে অসুবিধা নেই। বর্তমান উপ-উপাচার্য একজনকে দায়িত্ব দিয়ে চলে যান।
ভিসি পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে : বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসক, স্বাচিপ নেতা ও সরকারের স্বাস্থ্য খাতে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিসি হিসেবে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, সাবেক প্রো-ভিসি (প্রশাসন) এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি, করোনা মোকাবিলায় সরকারের গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা, সাবেক প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদারের নাম বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে প্রথম তিনজনের নাম তালিকার শীর্ষে রয়েছে।
অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের স্বাস্থ্য খাতের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রবীণ চিকিৎসক প্রথম দুজনের মধ্যে একজন ভিসি হতে পারেন বলে দেশ রূপান্তরের কাছে মন্তব্য করেছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার পুনরায় ভিসি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সার্বিক বিচারে আমার মনে হচ্ছে বর্তমান উপাচার্যই দ্বিতীয় মেয়াদে ভিসি থাকছেন। কারণ এখন যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতা ঠিক ভিসি হওয়ার মতো নয়। তা ছাড়া করোনা পরিস্থিতির সময় ভিসি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান ভিসি এই দফায় মোটামুটি ভালোই কাজ করেছেন; বিশেষ করে এমন কোনো কাজ তিনি করেননি, যা নিয়ে বিতর্ক করতে পারি। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই টার্ম ভিসি থাকে। বিএসএমএমইউতেও কেবল একজন ছাড়া সব ভিসিই দুই টার্ম করে ছিলেন।
তবে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লার ভিসি হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ডা. সহিদুল্লাকে যখন প্রো-ভিসি থেকে বাদ দেওয়া হয়, সেটা ঠিক হয়নি। তখনই তাকে ভিসি করতে পারতেন। তিনি ভালো মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রাখতে হলে তাকে ভিসি করাটা ভালো হবে। প্রয়োজনে তারপর আরেকজন আসতে পারেন। সরকার সেটাও বিবেচনায় নিতে পারে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যাকে দেবেন, আমি তার সঙ্গেই থাকব। আমাকে যদি দেন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আমি পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব। কারণ আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার, হাসপাতাল পরিচালক, প্রো-ভিসি, দীর্ঘদিন সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলে ছিলাম। মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ সভাপতি থেকে বিএমএ মহাসচিব, পেশাজীবী রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম। সুতরাং সবাইকে নিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্থবিরতা আছে, সেটা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হব বলে আমি মনে করি।
এ ছাড়া ভিসি পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান, প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন, লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খান, বর্তমান পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আবু নাসের রিজভীর নামও আলোচনায় রয়েছে।
কে হচ্ছেন প্রো-ভিসি (শিক্ষা) : ৭ মার্চ বর্তমান প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. সাহানা আখতার রহমানের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আজ তার শেষ কার্যদিবস। দু-এক দিনের মধ্যেই কে হচ্ছেন নতুন প্রো-ভিসি, তা জানা যাবে। এই পদে বেশ জোরেশোরে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, বিশ^বিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যালামনাই ট্রাস্ট সেক্রেটারি জেনারেল ডা. এস এম মোস্তফা জামান, নার্সিং অনুষদের ডিন ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ও নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। তবে ভিসি পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন প্রো-ভিসি পদেও নিয়োগ পেতে জোর তদবির করছেন বলে জানা গেছে।
তাদের মধ্যে বর্তমান পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আবু নাসের রিজভী ও অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীলের নাম ভিসি ও প্রো-ভিসি দুই পদেই শোনা যাচ্ছে। বর্তমান প্রো-ভিসি (শিক্ষা) পদে নার্সিং অনুষদের ডিন ও ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ও হৃদরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামানের নামও বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। চিকিৎসকদের কাছে এ দুজনেরই ক্লিন ইমেজ রয়েছে।
তদবির চলছে জোরেশোরে : ভিসি ও প্রো-ভিসি পদে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা সবাই সরকারদলীয় চিকিৎসক পেশাজীবী রাজনীতি ও স্বাচিপের সঙ্গে যুক্ত। তাদের প্রায় সবাই ছাত্রজীবনে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যুক্ত অনেকে। তবে ভিসি বা প্রো-ভিসি নিয়োগের ব্যাপারে সরাসরি কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা সবাই তাকিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দিকে। সেখান থেকে কার নাম আসে, তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলতে পারছেন না কেউ।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের উচ্চপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ এক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতীতেও যাদের নাম শোনা গেছে, তাদের কেউ হননি; বরং এসব নামে নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভিসি হবেন। বাইরে থেকে কাউকে করা হলে বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনায় সমস্যা হয়। বাইরের কারও সে রকম অভিজ্ঞতা নেই। আর ভেতর থেকেও তাদের গ্রহণ করা হয় না। এ পর্যন্ত বাইরে থেকে কাউকে ভিসি করা হয়নি।