হলগুলিতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা আর কত
আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানা নৃশংস ও লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা একের পর এক ঘটিয়া চলিয়াছে। শিশু ও নারী ধর্ষণ, নির্মমভাবে হত্যা ইত্যাদি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাইতে পিতা ও চাচা কর্তৃক ঘুমন্ত শিশুকে হত্যা করিয়া গাছে ঝুলাইয়া রাখিবার ঘটনাও ঘটিয়াছে সাম্প্রতিক কালে।
এই সকল নিষ্ঠুর ও পাশবিক ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। এমনকি যেই ছাত্রসমাজকে আমরা জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তা-চেতনায় অগ্রবর্তী বলিয়া মনে করি, সেইখানেও ঘটিতেছে নানা নৃশংসতার ঘটনা। সহপাঠী কর্তৃক আরেক সহপাঠী কীভাবে নির্যাতনের শিকার হন, তাহা আমাদের বোধোদয় হয় না। বর্তমানে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস বা হলগুলিতে প্রতিপক্ষ সংগঠনের অস্তিত্ব তেমন নাই বলিলেই চলে।
তাহার পরও ছাত্র নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়, যাহাতে আমরা বিস্মিত ও মর্মাহত। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের একশ্রেণির নেতাকর্মীর গ্রুপিংয়ের শিকার হইয়া অনেকে মার খাইতেছেন, ভয়ে ও আতঙ্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়িয়া দিতেছেন—যাহা মোটেও কাম্য নহে। কিছুদিন পূর্বে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফজলে রাব্বি হলে একজন ইন্টার্ন চিকিত্সক যেইভাবে নির্মম নির্যাতনের শিকার হইয়াছেন, তাহাতে নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নাই।
ভুক্তভোগী এ এস এম আলী ইমাম এই সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির নিকট যে লিখিত অভিযোগ করিয়াছেন, তাহা পড়িলে ও নির্যাতনের আদ্যোপান্ত জানিলে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষ মর্মাহত না হইয়া পারিবেন না।
একজন ইন্টার্ন চিকিত্সকে চড়-থাপ্পড়, লাথির পাশাপাশি রড দিয়া আঘাত করা হইয়াছে। তাহার শরীরকে করা হইয়াছে ক্ষতবিক্ষত। ভাঙিয়া দেওয়া হইয়াছে পায়ের হাড়। কয়েক বার বমি করিবার পরও তাহাকে নির্যাতন হইতে ক্ষান্ত হয় নাই একশ্রেণির ছাত্রনেতা ও কর্মী। অথচ হলের টিভিরুমে যেই জন্য তাহাকে মারধর হইয়াছে তাহা অত্যন্ত মামুলি বিষয়।
তাহার অপরাধ—তিনি মেডিসিন বিভাগের মাধ্যমে ইন্টার্ন শুরু করিতে চাহিয়াছিলেন; কিন্তু অভিযোগ রহিয়াছে যে, ইন্টার্ন চিকিত্সক পরিষদের নেতারা তাহাকে ইন্টার্নি করিবার সুযোগ দেন সার্জারিতে। এই লইয়া বাগিবতণ্ডা শুরু হয়। কে কোন বিভাগ হইতে ইন্টার্নি করিবেন ইহা তাহার ব্যক্তিগত ও প্রশাসনিক বিষয়। ইহাতে একটি পরিষদ কীভাবে নাক গলায়? এই হলে এমন ঘটনা নূতন নহে। ইহার পূর্বে ১২ জানুয়ারি কে-৭২ ব্যাচের দুই জন ইন্টার্ন শিক্ষার্থীকে মারিতে মারিতে হল হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয়। ৬ জানুয়ারি একই ব্যাচের আরেক জন শিক্ষার্থীকে একইভাবে নির্যাতন করিয়া হলছাড়া করা হয়।
চিকিত্সা শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হলে এই সকল কী হইতেছে? কলেজ কর্তৃপক্ষ কেন এই ব্যাপারে উদাসীন? অপরাধী যেই বা যাহারাই হউন না কেন, তাহাদের খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। যাহাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাহারা এমন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করিতেছে, তাহাদেরও চিহ্নিত করিতে হইবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটাইয়া হত্যা করেন তাহার সহপাঠীরা। এই ঘটনা সমগ্র দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। তাহাকে শের-ই-বাংলা হলের একটি কক্ষে ডাকিয়া আনিয়া বেধড়ক পিটানো হয়। তাহার মৃত্যুর পর যে মামলা করা হয় তাহা এখনো বিচারাধীন।
এই ধরনের নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার না হইলে তাহার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন। এ এস এম আলী ইমামের পরিণতি আবরারের মতো হইতে পারিত। ভাগ্যক্রমে তিনি বাঁচিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এই ধরনের ঘটনা যাহাতে আর কখনো সংঘটিত হইতে না পারে এই জন্য কি আমরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেছি?
ক্ষমতাসীন নহে এমন লোকদের হাতেও শিক্ষার্থী নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। উন্নয়নশীল দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা প্রায়শ বলিয়া থাকি; কিন্তু বাস্তবে তাহার প্রতিফলন দেখা যায় খুবই কম। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন, সচেতনতা, সহপাঠীর প্রতি সহমর্মিতা, মূল্যবোধের জাগরণ, অপরাধীর ব্যাপারে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, ভয় ও ভীতিমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ইত্যাদি ব্যতীত শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হইবে বলিয়া মনে হয় না।