বার্ধক্যে ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়
মোঃ হুসাইন আহমদ।।
বৃদ্ধাশ্রম নামটি শুনলেই চোখের সামনে ধরা দেয় ক্রন্দনরত মায়ের মুখ, আর কষ্টে জর্জরিত বাবার দুর্বল চাহনি। এ যেন জীবনের পরম অভিশাপ। সারাজীবন নিজের ছেলে মেয়েদের বড় করে, শেষ জীবনে সন্তানকে অবলম্বন করে বাঁচার চেষ্টা যেন আজ অন্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘
বৃদ্ধাশ্রম’ শব্দটি আমাদের দেশে এখনও মহামারী হিসেবে ধারণ না করলেও দিন দিন এর আবদার বেড়েই চলেছে। যদিও অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি হয়েছিল - যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই।
এখন যা আছে তা হল, ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচে’ বেশি আপন, যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে আমার হাসি মাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যাকুল থাকতেন, আমি না খেলে যিনি খেতেন না, আমি না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে থাকতেন আমার শিয়রে, যে বাবা-মা তিলে তিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমাকে মানুষ করার জন্য, সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রম।যা মানবতার প্রতি এক চরম উপহাস।
আর এই বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে অসাধারণ এক লেখায় যেন পুরো বিষয়টিকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন এক লেখক, এক অদ্ভুত সৃষ্টিতে।
"ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটের যায় না দেখা এপার ওপার ।
নানান রকম জিনিস, আর আসবাব দামী দামী
সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।
ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই আজ হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম!"
লেখাটি পড়ার সময় আমাদের কার না চোখ জলে ভেসেছে! জলে ভেজা ছলছল চোখের সামনে ধরা দিয়েছে মায়ের প্রিয় মুখখানি। মনে মনে শপথ নিয়ে ফেলি। কখনো মাকে চোখের জল ফেলতে দেবো না। সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকব। দশ মাস দশ দিন যেমন আঁতুড়ঘরে আমাদের ধারণ করে রেখেছিলেন, তার ঋণ তো কখনো শোধ হওয়ার নয়। তার সাথে আছে আমাদের বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত মেনে নেয়া সমস্ত আবদার। একটু অসুখ হলেই নিজে না ঘুমিয়ে আমাদের জন্য সারা রাত জাগা, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে আমাদের জন্য সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো, সন্তান না খাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকা- এসব কথা লিখতে লিখতেও শেষ হওয়ার নয়।
অথচ প্রকৃতির কি আজব খেয়াল, মানুষ জন্মানোর পর থেকে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পড়ালেখা শেষ করে সে স্বাবলম্বী হয়। তারপর বিয়ে করে সংসার। এর মাঝে বাবা-মায়েরও বয়স বাড়তে থাকে, কমতে থাকে শরীরের শক্তি, অবলম্বন হয়ে পড়ে সন্তানেরা। সংসারের হাল ধরে সকলের দায়িত্ব নেয় বাড়ির ছেলে।
কিন্তু কীসের খেয়ালে অতীতের সব স্মৃতি বিলুপ্ত হতে থাকে ছেলের।আর চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকে নতুন আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে। ঘরের মাঝে জায়গা পায় অবলা পশুপাখিও। কিন্তু মস্ত বড় ফ্ল্যাটেও জায়গার কমতি পড়ে শুধু মা বাবার জন্য। "এক সময়ের অবলম্বন সময়ের খেয়ালে বোঝা হয়ে পড়ে সন্তানের কাছে"। অবশেষে বাবা-মায়ের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। এই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়তো এখনো আমাদের সমাজে সচরাচর দেখা যায় না, খুব কম। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠিয়ে কোনো সেবা-যত্ন ছাড়া ঘরের এক কোণে ফেলে রাখার মধ্যেও নেই কোনো প্রকার বাহাদুরি।
এক তথ্যমতে; দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ছিল ১৯৯০ সালে ৪০ লাখ ৯০ হাজার। এরপর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৬০ লাখে। ২০১০ সালের পর ১ কোটি ২৫ লাখের বেশিতে এসে দাঁড়ায় এ সংখ্যা। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ হবে প্রায়।
এই ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা। আর তারা যেন মনে রাখে, আজকের নবীন ভবিষ্যতের প্রবীণ। তাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হবে বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাসস্থল। ডিজিটাল যুগের ইট-পাথরের পরিবেশেও অটুট থাকবে মিহি সুতায় বাঁধা পরিবারের সেই স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধন, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা।
অতএব, আপনার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। যে শিক্ষা আপনার সন্তানকে দিবে উপযুক্ত শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ,নৈতিকতা, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা। তারা আপনাকে বার্ধক্য বয়সে বুকের মধ্যে কোমল আচরণের মাধ্যমে আগলে রাখবে, প্রতিটা ক্ষণ স্নেহ-ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে। বার্ধক্যে কখনো বৃদ্ধাশ্রমে নয়। বরং বৃদ্ধাশ্রম ঠেকাও একটি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলবে।
লেখক-
শিক্ষার্থী, মারহালাতুত তাকমিল ( মাস্টার্স ডিগ্রী)
দারুস-সুন্নাহ টাংগাইল।