কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের কষ্ট কে দেখবে?
অলোক আচার্য।।
করোনা ভাইরাসের মহামারীর কারণে শিক্ষা কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি দীর্ঘসময় যাবৎ থমকে আছে। টেলিভিশন, অনলাইনে এ কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের সবাইকে এ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না। নানাবিধ সমস্যার কারণেই সেটি সম্ভব হয়নি। করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। মাধ্যমিকেও বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না। মাধ্যমিকের ঘাটতি পূরণ করতে ৩০ দিনের একটি সিলেবাস প্রণয়ন করেছে এনসিটিবি। এইচএচসি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত হচ্ছে।
কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয় স্বশরীরে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে উচ্চশিক্ষায় র্দীঘ সেশন জট তৈরি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। করোনাকালে কম বেশি সব শ্রেণিপেশার মানুষই সমস্যায় আছেন। শিক্ষকরাও এর বাইরে নন। তবে শিক্ষকদের মধ্যে নন এমপিওভুক্ত এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের এই যে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন রয়েছে সেখানে যারা শিক্ষকতা করছেন তারা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্ডারগার্টেনগুলো বহু শিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষের কর্মের সংস্থানও করেছে। না হলে বেকারত্বের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতো।
এই করোনাকালে তাদের অমানবিক জীবনযাপন,পেশা পরিবর্তন আমাদের কষ্ট দেয়। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়েছে পাঁচ হাজার স্কুল। এই পাঁচ হাজার স্কুলে যারা চাকরি করতেন তারা এখন কতটা অসহায় অবস্থায় আছেন তা ভাবতেও কষ্ট হয়। এছাড়া আগামী বছরের শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আরো ২৫ হাজার স্কুল। এতে চাকরি হারাবেন অন্তত পাঁচ লাখ শিক্ষক। এর অর্থ যে আমাদের বেকার মানুষের তালিকায় এরা যুক্ত হবেন। নতুন পেশা খুঁজবেন।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর হুট করেই নতুন এক পেশায় যাওয়া সত্যি কষ্টকর। তারপরও হয়তো অনেককেই বেছে নিতে হবে নতুন কোনো পেশা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়তো আর চালু হবে না। আবার করোনার পরে নতুন কিন্ডারগার্টেন হবে। কিন্তু আজ যারা দুর্দিনে সময় পার করছেন তাদের দুর্দশা কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। করোনার ঝুঁকি নিয়েই সব পেশার মানুষই এখন কাজে রয়েছে। শিক্ষা দানের প্রতিটি স্তরে যারা এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছে তাদের সবার দায়িত্বই এক। কিন্তু সব শিক্ষকের জীবন যাপন কি একই সরলরেখায় প্রবাহিত হয়? বহু প্রতিকুলতায়ও শিক্ষকদের শিক্ষাদানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ হয়নি।
কম পারিশ্রমিক, প্রতিকুল পরিবেশ কোনো কিছুই শিক্ষকদের দমাতে পারেনি। শিক্ষকরা আছে জন্যই সমাজ সুস্থতার আলো দেখেছে। যুগ যুগ ধরেই শিক্ষকরা এটাই করে আসছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা দানে যারা নিয়োজিত আছেন তারা সবাই শিক্ষক। দেশে লাখ লাখ শিক্ষক নিরলস প্রচেষ্টায় এই মহান কাজটি করে যাচ্ছে। এত এত গুণের সমাবেশ ঘটাতে হয় যে একজন অতিমানবেরও বুঝি এত ক্ষমতা থাকে না।
সেজন্য শিক্ষকতাকে পেশা না বলে সেবা বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের অবস্থা দেশে খুব একটা সুবিধার নয়। একজন শিক্ষককে বলা হয় আজীবন ছাত্র। জ্ঞান অšে¦ষণনে তার তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজে না শিখলে অন্যকে কি শেখাবেন। তাই তো তাকে পড়তে হয়, জানতে হয় এবং জানাতে হয়। এই জানানোর কাজটি হচ্ছে শিক্ষকতার জীবনের সবথেকে পরিশ্রমী এবং কঠিন কাজ। কারণ তার জানানোর কাজটি সফল হয়েছে কি না তা বুঝতে পারাও একটি বড় দক্ষতার ব্যাপার।
সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন প্রতিটি শিক্ষকের দায়িত্বই একজন শিক্ষার্থীকে মানুষ করে গড়ে তোলা। অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্যই এক ও অভিন্œ। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আয়ের মূল উৎস হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন, প্রাইভেট বা কোচিং ইত্যাদি। প্রাইভেটের ওপর নির্ভর জীবন যে কতটা দুর্বিষহ তা কেবল ভুক্তভোগী শিক্ষকরাই জানেন। কারণ প্রতিষ্ঠান থেকে যে বেতন দেয় তা প্রায়ই যৎসামান্য।
শহর ও মফস্বল অঞ্চলভেদে এই বেতনের হার কম বেশি হয়ে থাকে। তবে যাই হোক প্রাইভেট বা নন এমপিওভুক্ত শিক্ষক হোক তিনি একজন শিক্ষক এবং তিনি শিক্ষা দানের মতো মহৎ একটি পেশায় নিয়োজিত। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যেই এসব শিক্ষকের করোনাকালে জীবন ধারণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু সংবাদ চোখে জল এনে দেয়। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা দুর্দশায় আছেন। স্কুল বিক্রি করার মতো সংবাদও পত্রিকায় পড়তে হয়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দীর্ঘদিন না দিতে পারা, স্কুল ভবনের ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে না পেরে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেউ কেউ। স্কুল খুললেও ছাত্রছাত্রী সহসাই সেই প্রতিষ্ঠানে ফেরা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
শিক্ষকতা না থাকায় মৌসুমি ফলের ব্যবসার খবর বা অন্য ব্যবসার খবরও পড়েছি। সত্যি এই মানুষগুলো খুব কষ্টে আছেন। সামনে তাদের জন্য হয়তো আরও দুঃসময় অপেক্ষা করছে। এই সময়ে তাদের জন্য কোনোভাবে সাহায্য করা যায় কি না তা দেখা প্রয়োজন। এই শিক্ষকগুলোও দেশের লেখাপড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এদেরও ভূমিকা রয়েছে। এদের দুর্দশা ঘোচাতে কিছু করা প্রয়োজন। ঈদ বা পূজা কোনো উৎসবেই তাদের মুখে কোনো হাসি ছিল না। থাকার কথাও না। উপার্জনের পথ বন্ধ থাকলে হাসি আসবে কিভাবে?
লেখক-
সাংবাদিক ও কলাম লেখক ।