মুজিব বর্ষ বনাম বেসরকারি শিক্ষক জাতীয়করণ
বিশ্বজিৎ রায়।।
শুরু হলো নুতন বছর ২০২০ । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০২০ কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষনা করেছে।শুধু আমাদের দেশ নয় ১৯৫ টি দেশ এক সাথে পালন করবে এ উৎসব। আমরা গর্বিত জাতি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম গ্রহন করেছিলেন।
এই দিনটাকে কেন্দ্র করে সরকার সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠান মালার অয়োজন করেছে। বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। আমরা ভাগ্যবান যে জাতির জনকের এমন অনুষ্ঠানে আমরা অংশ করতে পারছি। এই দিনটাকে কেন্দ্র করে সকলের প্রত্যশা অনেক। আমরা বেসরকারি শিক্ষক।
আমাদের প্রত্যাশা অনেক নয়, একটি,সেটি জাতীয়করণ।শিক্ষা প্রশাসনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। এ বছর ১ জানুয়ারি তে ৩৫ কোটি৩১ লক্ষ নতুন বই বিতরণ হয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। নুতন আশা উদ্দীপনা নিয়ে শুরু হলো ২০২০। নতুন বছরে সবার নুতন নুতন প্রত্যাশা থাকবে। নুতন নুতন আশার সঞ্চার হবে প্রত্যেকের হৃদয়ে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের প্রত্যাশা পূরণের জায়গাটুকু ক্ষত বিক্ষত বার বার যেন হোচট খাচ্ছে ।
২০১৫ বেতন গেজেট প্রকাশের পর থেকে তারা কিছুটা বৈষম্যের স্বীকার হয়েছিল। তাদের দাবীর কথা কখনও লিখিত আবার কখন মৌখিক কখনও প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বলে আসছিল। আবার কখনও আন্দোলের মাধ্যমে। কিন্তু আশার বিন্দুতে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার হয়েছে ৫% প্রবৃদ্ধি ও ১০% নববর্ষ ভাতা পাওয়ায়। এ দেশে বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। সেই বৃটিশ আমল থেকে শিক্ষকদের বঞ্চনার বীজ রোপিত হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেমুজিববর্ষে জাতীয়করণ অাশায় আশান্বিত বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে।শিক্ষা ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বছরের প্রথমে কোটি কোটি বই পৌছিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর কাছে। এমপিও ভূক্তিতেও এসেছে ডিজিটালাইজড ব্যবস্থা ।
ইত্যোমধ্যে শিক্ষদের জন্য PDS চালু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে বসে এমপিও ই - আবেদন ফরম পূরণ করলে এমপিও ভূক্ত হওয়া যাচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগ এসেছে পরিবর্তন। বিসিএস এর আদলে তিনটি স্তর ফেস করে নিয়োগ পেতে হচ্ছে। ডি আই এ সনাতনী পরিদর্শন পদ্ধতি বাদ দিয়ে চালু করতে যাচ্ছে পিয়ার ইন্সপেকশন।
এ পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান তার ডাটা তার নিজস্ব ওয়েভ পেজে দিয়ে রাখবে। ডি আই এ সেটি যাচাই বাছাই করবে। উপবৃত্তি ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। এখন ছাত্রীদের পাশাপাশি ছেলেরাও পাচ্ছে। ৬০ হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বৃত্তি পাওয়াসহ ব্রেইলি বুক পাচ্ছে। ২০ হাজার কম্পিউটার ল্যাব ও উপজেলা আইসিটি রিসোর্স সেন্টার স্থাপিত হয়েছে।৫২২ টি স্কুলে চালু হয়েছে কারিগরি শিক্ষা। ২৪ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশ।
সরকার ইতোমধ্যে সকল প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার, প্রজেক্টর,মডেম ও ডিসপ্লে স্ক্রিন বিতরণ করেছে। শিক্ষকরা সেই সনাতনী পদ্ধতি বাদ দিয়ে আংশগ্রহণ পদ্ধতিতে ক্লাশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল প্রতিভা বিকশিত করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন। পরীক্ষা পদ্ধতির পরিরর্তনে শিক্ষার হারেও এসেছে পরিবর্তন। কারিগরি শিক্ষা বিস্তারের ফলে দেশে বেকারত্বের হার কমেছে। অর্থনীতি হচ্ছে সমৃদ্ধি ।
বিদ্যালয় গুলোতে নির্মিত হচ্ছে অাধুনিক ভবন। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছে। সৃজনশীল মেধা খুঁজে বের করার জন্য চালু হয়েছে "সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ "প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্র উন্নয়নে চালু হয়েছে "সততা সংঘ"। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য চালু হয়েছে "স্টুউডেন্ট কেবিনেট" নির্বাচন । শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে তাদের নেতা নির্বাচন করবে।শারীরিক ও মানষিক শাস্তি বন্ধের ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানষিক বিকাশের অপরাপর সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। চালু হয়েছে কিশোরী ক্লাব।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চত কল্পে শিক্ষকরা ইন- সার্ভিস প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।২০১০ সালে সার্বজনীন ও যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি পেয়েছি। তারই বাস্তবতায় রচিত হয়েছে শিক্ষাক্রম ২০১২।সেসিপ কিছু জনবল নিয়োগ দিয়ে মাধ্যমিক খাতকে প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে রেখে মাধ্যমিক খাত উন্নয়নে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই ক্রমোন্নতিতে বেসরকারি শিক্ষকরা যে একটা বড় অবদান রাখছে তা কোনক্রমে অস্বীকার করা যাবে না।
কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে তা এ যাবৎ কালের রেকর্ডকে হার মানিয়েছে।
(ক) গাড়ি ও বাড়ির জন্য সুদ মুক্ত ঋণ
( খ) ৫% প্রবৃদ্ধি প্রদান( গ)উচ্চতর স্কেল প্রদান (ঘ) বয়স বৃদ্ধি,১ম ধাপে ৫৭ থেকে ৫৯ বছরে পরবর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ৬০ বছরে উন্নিত করণ। ( ঙ) শতভাগ রেশন( চ) ধোলাই ভাতা। ( ছ) ২০% বৈশাখী ভাতা।( জ) পুলিশ বাহিনীর জন্য ঝুকি ভাতা ( জ) প্রথমিক ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যলয়ের শিক্ষকদের মর্যাদাবৃদ্ধি, স্কেল অাপগ্রেড ও পদোন্নতি ( ঝ) রয়েছে স্থান পরিবর্তন বা বদলীর সুযোগ। ( ঞ) স্থান ভেদে ৪০% থেকে ৫০% হাউজ রেন্ট। ( ট) ১৫০০/- মেডিক্যাল( ঠ) পূর্নাঙ্গ উৎসব বোনাস ইত্যাদি আরও আরও কিছু।
অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষকরা ( ক)১০ বছর পূর্তিতে শিক্ষকরা উচ্চতর স্কেল পাচ্ছেনা।(খ) নূন্যতম একটি বাড়ি ভাড়া ও একটি মেডিক্যাল ভাতা পাচ্ছে যা দিয়ে বাড়ি ভাড়া বা চিকিৎসা খরচ মেটানো খুবই দূরহ।( গ)মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষদের উৎসব পালন করতে হচ্ছে।( ঘ) পাচ্ছে না সন্তানকে লোখাপড়া শেখানো ভাতা ( ঙ) পাচ্ছেনা সরকার প্রদও গৃহঋণ।(চ) না আছে বদলী। (ছ) অবসর কল্যানের টাকা বেচে থাকতে কপালে জুটছে না। বেসরকারি খাত জাতীয়করণের এখন সময় এসেছে। পৃথিবীর কোথাও শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবে পরিচালিত হয় না। সরকারি - বেসরকারি বৈষম্য আকাশচুম্বী। একজন ৮ম শ্রেণি পাশ পিওনের বেতন একজন গ্রাজুয়েট করা শিক্ষকের চাইতেও বেশি। এই মানষিক যন্ত্রনার মধ্যেও একজন শিক্ষক জাতি বিনির্মানে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এশিয়ার "নুতন বাঘ"।বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কৌশিক বসু বলেছেন " বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনায় রয়েছে। শিগগিরই দেশটি এশিয়ার নুতন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হবে"।খ্যাত নামা ম্যাগাজিন দ্যা ইকোনমিস্টের সর্বসেরা শীর্ষ চার দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। লন্ডন ভিত্তিক পত্রিকাটির " সমীহ জাগানো দেশ " শীরনামের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নতি ও দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ার জন্য বিশ্বে বাংলাদেশ এভাবে পরিচয় পাচ্ছে ।রিজার্ভ এ যাবৎ কালের রেকর্ডকে হারিয়েছে। জিডিপি৭. ২৮ এবং মাথা পিছু আয় ১৬১০ ডলার। খাদ্য,দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।১৩৩ টি দেশে ঔষধ রপ্তানি হচ্ছে।দেশে তথ্য প্রযুক্তির সেবা বৃদ্ধির জন্য ২৮ টি হাইটেক পার্ক নির্মিতি হতে যাচ্ছে যাতে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। পদ্মা সেতু, পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র,মেট্রো রেলের মত মেঘা মেঘা প্রকল্প দেশে অর্থ দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণে খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা। এটা দেশের সক্ষমতার তুলনায় কম।
৩০ নভেম্বর ২০১৫ খ্রীস্টাব্দে সাবেক শিক্ষাসচিব এনআই খান মহোদয় বিদায় নেওয়ার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে ১০০০ কোটি টাকা প্রয়োজন এর কথা বলেছিলেন। স্কুল কলেজ জাতীয়করণ লিয়াজে কমিটির মহাসম্মেলনে মাননীয় মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেছিলন" জাতীয়করণ শীঘ্রই"। বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও তালা উপজেলার এক সমাবেশে "বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের বিষয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন "। সর্বশেষ মাননীয় বানিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ বলেছেন " জাতীয় করণ হতেই হবে"।
আমরা বেসরকারি শিক্ষরা আশায় বুক বেঁধে আছি। জাতিরজনক ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাতীয়করণ করে শিক্ষার ভিত মজবুত করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি ২৬ হাজার রেজিষ্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উপজেলা সদরে ১ টি স্কুল ১ টি কলেজ জাতীয়করণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আবার প্রত্যেক উপজেলায় মাদরাসা জাতীয়করণের কাজ চলছে। জাতিরজনকের সুযোগ্য উত্তরসূরি আপনি। আপনিই পারবেন সকল বৈষম্য দূরকরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে।
যেমনি ষাড়ে ছয় লাখ রেহিঙ্গা অশ্রয় দিয়ে বিপন্ন মানবতা রক্ষা করেছেন। বিশ্ব সম্প্রদায় আপনাকে "মাদার আব হিউম্যানিটি " বলে আখ্যা দিয়েছেন।যেমনটি করেছেন বিশ্ব ব্যাংকে অর্থ ফিরিয়ে দিয়ে,নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে। তেমনি মুজিববর্ষে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে কবে, কখন, কোন সময়, কোন মহেন্দ্র ক্ষনে জাতীয়করণের ঘোষনা আসে আপনার মুখ দিয়ে।
লেখক: শিক্ষক, মৃজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
তালা, সাতক্ষীরা।