শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ও শিক্ষার পরিবেশ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর একে অন্যের সাথে অঙ্গা অঙ্গিভাবে গাঁথা। সেখানে সম্মান,শ্রদ্ধা এবং শিক্ষা প্রদানের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে। এখানে নৈতিকতার শিক্ষা পাওয়ার সাথে সাথে তা চর্চাও হবে। কিš‘ ইদানিংকালে তা হচ্ছে কি?
শিক্ষকদের ওপর থেকে শিক্ষার্থীদের সেই সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা কমে গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীর হাতেই তার শিক্ষককে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে আবার কোথাও শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবকরা শিক্ষককে আঘাত করছে, অপমান অপদস্থ’ করছে। শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবির সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সাথে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।
কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ যেমন ছাত্রছাত্রীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার থাকে সেভাবেই থাকে তাদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গøানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে।
এটাই শিক্ষকতা। মাত্র কিছুকাল আগেই ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। আবার সম্প্রতি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একটি ঘটনা পত্রিকায় দেখেছি। পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, শ্যামনগরের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেমকে বেধড়ক মারপিট করে শিক্ষার্থীর অভিভাবক। প্রধান শিক্ষকের লিখিত অভিযোগে যা জানা যায় তা হলো, তিনি ক্লাস নেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা তার বসার চেয়ারে সুপার গ্লু লাগিয়ে রাখে যার ফলে শিক্ষক বসে উঠতে গেলে তা লেগে যায়। এতে শিক্ষার্থীরা আনন্দিত হয়। এর কারণে তিনি শিক্ষার্থীদের মৃদুভাবে কয়েকটি চড় মারেন ওই প্রধান শিক্ষক। যার ফলশ্রুতিতে তিনি বাড়ি ফেরার সময় শিক্ষার্থীর কয়েকজন অভিভাবক তাকে মারধর করে।
বিষয়টি নিয়ে ভাবার আছে। একজন শিক্ষক ক্লাস নেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা দুষ্টামির ছলেই যদি ধরে নেই তবুও তারা গর্হিত একটি অপরাধ করেছে। যার ফলে তাদের মৃদু শাস্তি দিয়েছেন তিনি। এটা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। কারণ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শাসন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিš‘ এর ফলে অভিভাবকরা তাকে রাস্তায় মারধর করবে এটা ভাবনারও অতীত। উল্টো তাদের উচিত ছিল নিজের সন্তানের কর্মকান্ডের জন্য শিক্ষকের কাছে দুঃখপ্রকাশ করা।
আজকাল তা করে না। বরং শিক্ষার্থীকে মৃদু শাসন তো ভালো অনেক সময় কড়া ভাষায় কথা বললেও তাকে অভিযোগ শুনতে হয়! সুতরাং দেখা যায় যে, নৈতিক অধঃপতন শুধু ছাত্রছাত্রীর ঘটছে না বরং তাদের অভিভাবকদেরও ঘটছে। মোট কথা একটি সামাজিক ব্যাধী ছড়িয়ে পরেছে। যার পেছনে আছে নিজের ক্ষমতা জাহির করার মিথ্যা অহংকার।
এর জন্য পুরো সমাজব্যবস্থাই এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিজেও এর জন্য দায়ী থাকেন। এই ঘটনা কেন ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ঐ অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখি নি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই।
শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তার কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? আবার ছাত্রের দ্বারা শিক্ষক লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্চিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল এই সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে।
একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। দেশের মেধাসম্পদ তৈরি করার মূল কারিগর হলো শিক্ষক। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করে। দেশকে কিছু দেওয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে থাকবে বিশ্বাস,ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময় আমাদের আরও খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক-
অলোক আচার্য
শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক