কারাগারে ৪৯ দিন কাটানোর পর বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরেছেন বরগুনায় চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের শিকার রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। হাইকোর্টের আদেশে গতকাল মঙ্গলবার জেলা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পরিবারের সদস্যরা পরে তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। তার মুক্তি পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে কারাগার প্রাঙ্গণে ভিড় করে উৎসুক জনতা।
বরগুনা কারাগারে মিন্নির মুক্তির সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হতে গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টা বেজে যায়। তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ও আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বাবার হাত ধরে কারা ফটক থেকে বের হন ১৯ বছর বয়সী কলেজ ছাত্রী মিন্নি। তার মা, ভাইসহ অন্য আত্মীয়সহ তারা সদর উপজেলার নয়াকাটা গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেন।
এর আগে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মিন্নির উচ্চ আদালতের দেওয়া জামিনের রায়ের অনুলিপি বরগুনায় পৌঁছায়। তার আইনজীবী বরগুনার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে উচ্চ আদালতের রায়ের আদেশসহ একটি বিবিধ মামলা করেন। আদালতের আইনি প্রক্রিয়া শেষে বিকেলে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি মেলে তার। এর আগে গতকাল সকালে এ মামলায় মিন্নিসহ কারাগারে থাকা ১৪ জন অভিযুক্তকে বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে হাজির করা হয়।
প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে আদালতে যাওয়ার পথে মিন্নির সঙ্গে দেখা হয় তার বাবার। এ সময় মিন্নিকে তার বাবা বলেন, সবকিছু গুছিয়ে রাখিস। তখন মিন্নি বলেন, ‘তুমি যাওয়ার সময় জামা-কাপড় নিয়ে যাইয়ো।’
রিফাতকে গত ২৬ জুন বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার সময় তার স্ত্রী মিন্নি তাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফের করা মামলায় মিন্নি ছিলেন প্রধান সাক্ষী। পরে এ হত্যাকাণ্ডের সময়কার আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে মিন্নির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরই মধ্যে মিন্নিকে তার বাড়িতে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়। রিফাতের বাবাও তার সংশ্নিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন। নানা নাটকীয়তার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের তিন সপ্তাহ পর ১৬ জুলাই মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে এনে জেলা পুলিশ গ্রেফতার দেখায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রিফাত হত্যা পরিকল্পনায় তার স্ত্রীও জড়িত ছিলেন।
এরপর বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গত ২৯ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে মিন্নির জামিন দেন হাইকোর্ট। পরে রাষ্ট্রপক্ষ এ আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে যান। গত সোমবার চেম্বার আদালতের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনে ‘নো অর্ডার’ দেন। এর ফলে হাইকোর্টে দেওয়া মিন্নির জামিন আদেশ বহাল থাকে।
আলোচিত এ ঘটনা বিভিন্ন সময়ে নানা মোড় নেয়। এ ঘটনার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। পরে গত ১৬ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে মিন্নিকে তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে পুলিশ লাইন্সে নিয়ে আসে পুলিশ। ওইদিন রাত সোয়া ৯টায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পরদিন বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ রিমান্ড আবেদন করলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এ সময় আদালতে মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।
পর দিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়। হঠাৎ করে ১৯ জুলাই একই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মিন্নি। ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন করা হলে নাকচ করে দেন বিচারক। এরপর ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা জজ আদালতে জামিন আবেদন করলে তাও নাকচ হয়ে যায়। পরে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেও তা ফিরিয়ে নেন মিন্নির আইনজীবী।
পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতে মিন্নির জামিন নিয়ে শুনানিকালে আদালত বলেন, পুলিশ তদন্তে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে অবশ্যই প্রধান সাক্ষী মিন্নি মামলায় আসামি হতে পারেন। কিন্তু মূল আসামিদের বাদ দিয়ে মিন্নিকে নিয়ে বেশি উৎসাহিত হওয়া উচিত হবে না। মিন্নির ভুল স্বীকার মর্মে পুলিশ সুপার (এসপি) যে বক্তব্য দিয়েছেন তা হতাশা ও দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। ভবিষ্যতে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তদন্তাধীন বা বিচারাধীন মামলার বিষয়ে ব্রিফ করলে সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে বলেও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন আদালত।
গত বৃহস্পতিবার মিন্নির জামিনের রায় ঘোষণার সময় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ বিষয়ে সময়মতো ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া রিফাত হত্যার ঘটনায় করা মামলা বিচারাধীন বিষয় বিধায় আদালত এ ব্যাপারে কোনো আদেশ দিচ্ছেন না। তবে কোনো মামলার তদন্ত ও বিচারাধীন বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কোনো আসামি গ্রেফতারের পর তাকে গণমাধ্যমের সামনে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রেস ব্রিফিং করার ব্যাপারে নীতিমালা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
মিন্নিকে নাটকীয়ভাবে গ্রেফতারের সময় আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সমালোচনা হয়। ওই সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও বলা হয়, বিষয়টি সঠিক হয়নি। মিন্নির আইনজীবী না পাওয়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সবার সমান বলে মন্তব্য করেন মানবাধিকার কর্মীরা। নারীনেত্রীরা প্রভাব ও ভীতিমুক্ত বিচারের দাবি জানান। এ বিষয়ে জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিয়েও ভেবে দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে গতকাল কারাগার থেকে মিন্নি মুক্তি পাওয়ার পর বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। আজকে আইনি লড়াই করে আদালতের মাধ্যমে আমার মেয়েকে জামিনে মুক্ত করতে পেরেছি। এক্ষেত্রে আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ যারা আমার মেয়ের পক্ষে কাজ করেছেন তাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’ তিনি আবারও বলেন, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। একটি প্রভাবশালী মহল রিফাত হত্যা মামলার মূল আসামিদের রক্ষা করতেই পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়েকে আসামি করেছে।’
মিন্নির আইনজীবী ও বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, ‘গত ২১ জুলাই থেকে মিন্নির জামিনের জন্য আইনি লড়াই করে আসছি। সর্বশেষ ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট মিন্নির জামিন আদেশ দিয়েছেন। ওইদিন আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আজকে মিন্নিকে জামিনে মুক্ত করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।’
মামলার বর্তমান অবস্থা : গতকাল আলোচিত হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর কারাগারে থাকা ১৪ জন অভিযুক্তকে মামলার শুনানির জন্য সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছয়জনের বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় আদালত তাদের খুলনার শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তারা হলো- রিশান ফরাজী, তানভীর, চন্দন, অলি, নাজমুল ও শ্রাবণ। বাকি অভিযুক্তদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে গত রোববার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। একইসঙ্গে ১ নম্বর আসামি নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.