লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ।।
আমার এক সহকর্মী বিগত এক বছর যাবৎ আমাকে প্রায়ই বলে আসছেন বদলি নিয়ে লেখালেখি করতে। আমিও লিখব লিখব করে আর লেখা হয়নি। কিন্তু ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় বদলির বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে শিক্ষক সমাজ। আর এতে শামিল হওয়ার অভিপ্রায়ে আমিও কলম ধরলাম দুটো কথা লিখতে।
বাইরের কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ না হলেও শুনেছি উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষকদের নানা সুযোগ-সুবিধাসহ আলাদা কদর আছে। সে হিসেবে আমরা বহু পিছিয়ে। তবে ভাগ্য ভাল, আমাদের শিক্ষক সমাজের স্বল্প আয়ে তুষ্ট থেকে জীবন অতিবাহিত করার অভ্যাস আছে। ব্যাতিক্রম থাকলেও তার সংখ্যা খুবই সীমিত। শিক্ষকদের অল্পে তুষ্ট থাকার অভ্যাস না থাকলে এদেশের অবস্থা আরো খারাপ হত।
এমনিতেই শিক্ষক সমাজ ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে; বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা। তার উপর ব্যয়ের সাথে আয়ের তফাৎ বেশি হলে পরিণতি খুব ভাল হবে বলে মনে হয়না। যতই শিক্ষকদের সম্মানের কথা আমরা বলিনা কেন, বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মানতেই হবে; সম্মানের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বচ্ছলতা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর নিতান্ত সম্মান পেয়ে থাকলেও, শিক্ষক পরিবারের সদস্যদের কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়।
শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের দিক দিয়ে সরকারের আন্তরিকতা নেই, তা বলা যাবেনা। তবে বেসরকারি শিক্ষকদের অল্প আয়ের সাথে বাড়ী ভাড়া (১০০০ টাকা), চিকিৎসা ভাতা (৫০০ টাকা), আর ঈদ বোনাস বেতনের ২৫% সময় উপযোগি নয়ই; বরং অনেকটা হাস্যকর একটা বিষয়। শিক্ষকদের বাদ দিয়ে অন্য যেকোন দিক দিয়েই পরিবর্তনের চেষ্টা করা হোক না কেন, তা কখনোই ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয়না। কারণ, শিক্ষক দিয়েই যেখানে এ ক্ষেত্রটা পরিবর্তন হবে, সেখানে শিক্ষক নিজে সমৃদ্ধ না হলে পরিবর্তনে তিনি মনোযোগি হবেন কিভাবে?
তবে যে আয় এবং সামান্য যে সুবিধা তাতেও শিক্ষকরা মোটামুটি সন্তষ্টিই প্রকাশ করছেন; কিন্তু ব্যয়টা কমিয়ে আনার জন্যই বদলি ব্যাবস্থার এত জোর দাবি। অর্জিত আয়ে যদি নিজ বাড়ী থেকে দূরে চাকরি করতে হয় তাহলে ব্যয়ের সাথে আয়ের তফাৎ বেশি হয়ে যায়; যা সচেতন ব্যাক্তি মাত্রই মেনে নেয়া অসম্ভব। কারণ দৈনিক আসা-যাওয়া করলে যাতায়াত ভাড়া এবং পরিশ্রম, কাছে থাকলে বাসা ভাড়া। বর্তমান সময়ে দুটোই ব্যয়-বহুল।
এবার একটু তুলনায় আসি। সারা বাংলাদেশে প্রায়ও ২৫ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা) রয়েছে। যাতে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায়ও ৫ লক্ষ। মাধ্যমিকের একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন ১২৫০০ টাকা (বিএড ছাড়া) আর ১৬০০০ টাকা (বিএড থাকলে)। অথচ একজন ৩য় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর মাসিক বেতন প্রায়ও ২০০০০ টাকা। আর তুলনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা।
আয়-ব্যয় এবং তুলনার হিসাব ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ক্ষোভ থেকে বুঝা যায়- দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে অনীহা, পরিবারকে সময় দেয়ার ইচ্ছা, স্থানীয় শিক্ষকদের বেপরোয়া মনোভাব, প্রতিষ্ঠান প্রধান,সহ-প্রধানদের তোয়াজ এবং ম্যানেজিং কমিটির নানামুখী চাপসহ আরো বহুমুখী সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য বেসরকারি শিক্ষকেরা বদলির মনোভাবে সোচ্চার। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ও দূর্নীতি রোধের জন্যও বদলি প্রয়োজন বলে মত ব্যক্ত করছেন অনেকে।
স্বাভাবিক নিয়মে চিন্তা করলেও বদলির দাবি অপ্রাসঙ্গিক নয়। কেননা শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড হলে, শিক্ষক হল সেই মেরুদন্ডকে সুস্থ-সবল রাখার হাতিয়ার। এমন শিক্ষক যদি মানসিক চাপে থাকে তাহলে জাতির শিক্ষক নামক হাতিয়ারটা অকেজো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর হাতিয়ারই যদি অকেজো হয়ে যায় তাহলে মেরুদন্ডকে সুস্থ-সবল রাখবে কে?
এমপিও নীতি মালা ২০১৮ জারি হওয়ার পর বেসরকারি শিক্ষকদের মনে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছে। কেননা এতে বলা হয়েছে, সরকার ইচ্ছে করলে বদলি ব্যবস্থা করতে পারবে। প্রয়োজন শুধু বদলি সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়ন এবং তা বাস্তবায়ন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত সে ধরণের কোন সু-লক্ষণ দেখে বেসরকারি শিক্ষকদের মনে সঞ্চারিত আশার আলোতে হতাশার দানা বাঁধতে শুরু করেছে। যা থেকে পরিত্রাণ অপরিহার্য।
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষক হল জাতির দর্পণ; মানে আয়না। এখন আয়নাতেই যদি ময়লা ধরে যায় তাহলে জাতি তার চেহারা দেখবে কিভাবে? চেহারাই যদি পরিষ্কার দেখা না যায় তাহলে নিজেকে ঠিক রাখবে কিভাবে? আর জাতি নিজেই যদি ঠিক না থাকে তবে উন্নত রাষ্ট্রের সাথে তাল মিলাবে দূরে থাক, উল্টো না আবার অন্য জাতির কাছে সারা জীবনই মাথা নুইয়ে থাকতে হয়! কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের আবার সে অভ্যাস এবং ইতিহাস কোনটাইতো নেই। তাইতো সরকারের উচিত বেসরকারি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া।
লেখক-
সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং শিক্ষক।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.