এইমাত্র পাওয়া

পাঠ ছেড়ে মাঠে শিক্ষকরা, শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা লজ্জিত

।। সিমরান জামান।।

একজন শিক্ষক মানেই জ্ঞানের আলো, মেধার বিকাশ, নৈতিকতার ভিত্তি। শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল ইট-পাথরের একটা ভবন, আর শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে পড়ে অচল যন্ত্র। অথচ আজ সেই শিক্ষকই ন্যায্য দাবির জন্য রাজপথে। হাতে বই নয়—প্ল্যাকার্ড, ক্লাসরুম নয়—প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক, ল্যাবরেটরি নয়—শহীদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি। এ দৃশ্য কোনো শিক্ষিত জাতির জন্য গর্বের নয়—এ এক বেদনাদায়ক, অপমানজনক ও বিপজ্জনক বাস্তবতা।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন এক ভয়াবহ অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূর করার দাবিতে দেশের ৩০ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে গেছেন। সঙ্গে রয়েছেন দেড় লাখেরও বেশি কর্মচারী। এর বাইরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষক ১১তম গ্রেডের দাবিতে ১৭ অক্টোবর থেকে ঢাকায় আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাও কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন—ফলে দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক, এমনকি কলেজ পর্যায়েও শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত বন্ধ। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষা মাথায় রেখেও কেউ ক্লাসে ফিরছেন না। শিক্ষকরা বলছেন, “বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকার কিছুই বাস্তবায়ন করেনি, তাই এবার দাবি আদায় না করে ফিরে যাব না।”

এ আন্দোলনের মূল স্রোত হচ্ছে ন্যায্য ভাতার দাবি। শিক্ষকরা বর্তমানে মাসে মাত্র ১,০০০ টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান—যেখানে রাজধানীতে একটি পরিবারের গড় বাড়িভাড়া ১৫,০০০–২৫,০০০ টাকার কম নয়। এই ব্যবধান কেবল আর্থিক নয়, এটি শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা ও অবমূল্যায়নের স্পষ্ট প্রমাণ।

শিক্ষকদের আন্দোলনে শুধু নীরবতা নয়, দেখা দিয়েছে সহিংসতা ও অপমানও। প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচির সময় পুলিশ শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। আহত হন অন্তত তিনজন শিক্ষক, আটক হন ছয়জন। এমন দৃশ্য একজন শিক্ষার্থী হিসেবে দেখা সত্যিই হৃদয়বিদারক।

আমরা যারা ক্লাসে বসে শিক্ষকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি, তাঁদের কাছ থেকে শিখি, সেই শিক্ষকদের রাস্তায় ফেলে মারধর করা হচ্ছে—এ ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত অপমান নয়, এটি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আঘাত। শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা মানে শিক্ষাকে লাঞ্ছিত করা, জাতির আত্মাকে আঘাত করা।

শিক্ষকদের আন্দোলন এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। শিক্ষা উপদেষ্টা বা সচিবদের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। “২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে” এই এক লাইনেই থেমে আছে সরকারের বক্তব্য।

কিন্তু শিক্ষকরা বছরের পর বছর এই ধরনের আশ্বাস শুনেছেন—বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। প্রতিবারই বৈঠক হয়, প্রতিশ্রুতি মেলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব হারিয়ে যায় কাগজের গহ্বরে। এই উদাসীনতা কেবল আন্দোলনকে উস্কে দেয় না, শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজারের বেশি। এসব বিদ্যালয়ে পৌনে ৪ লাখ শিক্ষক কর্মরত। কিন্তু তারা এখনো ১৩তম গ্রেডে বেতন পান, যেখানে তাদের দাবি ১১তম গ্রেড। এই দাবিতে তারা গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন। বেতন কাঠামোর এ বৈষম্য শুধু তাদের আর্থিকভাবে দুর্বল করে রাখছে না, মানসিকভাবেও হতাশ করে তুলছে।

একজন প্রাথমিক শিক্ষক যখন ১৩তম গ্রেডের বেতনে সংসার চালান, তখন তাঁর পক্ষে নিজের সন্তানকে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। আর্থিক অনটনে যখন তিনি বিপর্যস্ত, তখন তিনি কীভাবে আগামী প্রজন্মকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করবেন?

দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে বিদ্যালয়-কলেজে পাঠ বন্ধ। পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে, অথচ সিলেবাসের অনেক অংশই অসম্পূর্ণ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপ। অনেকের মনে প্রশ্ন—“শিক্ষক যদি রাস্তায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়?”

এমন অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আস্থার সেতু ভেঙে যাচ্ছে। রাষ্ট্র যদি দ্রুত এই সংকট সমাধান না করে, তাহলে এই আস্থাহীনতা আগামী প্রজন্মের শিক্ষার মানে বড় ধস নামাবে। শিক্ষা কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নয়; এটি আস্থা, সম্পর্ক ও সামাজিক সম্মানের জায়গা। সেই জায়গাটিই ভেঙে পড়ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান মজবুত হয়নি—এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী খুব সঠিকভাবেই বলেছেন, “যে জাতির শিক্ষকরা কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না; আর্থিকভাবে ভঙ্গুর; সেই জাতি কীভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে?”

মাত্র সাড়ে ১২ হাজার টাকার বেতনে একজন শিক্ষক কীভাবে টিকে থাকবেন? আজ দ্রব্যমূল্যের এই বাজারে একজন সাধারণ শ্রমিক পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি আয় করে। অথচ যাঁদের হাতে জাতির ভবিষ্যৎ, তাঁরা আর্থিক দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন।

এই আন্দোলন শুধু বাড়িভাড়া বা বেতন বৃদ্ধির লড়াই নয়—এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি। শিক্ষককে বঞ্চিত রেখে কোনো জাতিই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করতে পারে না। শিক্ষক যদি অস্বস্তিতে থাকেন, তিনি মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করতে পারবেন না। তখনই শুরু হয় কোচিং ও বাণিজ্যিক শিক্ষার দৌরাত্ম্য।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী যেমন বলেছেন- “শিক্ষকদের বেতন নেই বলেই শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না। তারা ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে প্রাইভেট-কোচিংয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন, কারণ তাদের তো টিকে থাকতে হবে।”

রাষ্ট্র যখন শিক্ষককে তাঁর প্রাপ্য দেয় না, তখন শিক্ষক বাধ্য হন অন্য খাতে মনোযোগ দিতে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে শিক্ষার মানে।

একজন শিক্ষককে পুলিশ রাস্তায় টেনে নেওয়ার দৃশ্য কেবল অমানবিক নয়, এটি সমাজে একটি ভয়ংকর বার্তা পাঠায়—“শিক্ষকও আজ অরক্ষিত।” যে শিক্ষক শিশুর নৈতিকতা গঠনের শিক্ষা দেন, সেই শিক্ষককে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী লাঞ্ছিত করে, তাহলে সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কোথায় থাকবে?

শিক্ষককে অপমান করা মানে জাতিকে অপমান করা। এ ধরনের ঘটনা যদি বারবার ঘটে, তাহলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হবে। এতে সমাজের ভিত্তি দুর্বল হবে—যা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো বিনিয়োগ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব নয়।

বিশ্বের যেসব দেশ আজ উন্নত, সেসব দেশের শিক্ষা নীতির মূল কেন্দ্রে আছে “শিক্ষক”। যেমন—ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, কানাডা—সব জায়গায় শিক্ষক পেশাকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। সেখানে একজন শিক্ষককে এমনভাবে সম্মান ও বেতন দেওয়া হয় যাতে তিনি নিশ্চিন্তে জ্ঞান বিতরণে মনোযোগ দিতে পারেন।

বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র। এখানে শিক্ষক পেশাকে ক্রমশ আর্থিক সংকটে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেবল বক্তৃতায়, নীতিতে নয়।

রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব নাগরিকদের শিক্ষা নিশ্চিত করা। আর শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হলো শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে শিক্ষা খাত টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত—দ্রুত ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানো।প্রাথমিক শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড বাস্তবায়ন।বেতন কাঠামোতে বৈষম্য দূর করা।শিক্ষক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

শিক্ষককে যদি রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফেরানো না হয়, তাহলে এর মূল্য দিতে হবে গোটা জাতিকে।

একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ অবস্থার মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষক ছাড়া ক্লাসরুম মানে শূন্যতা। প্রশ্নপত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাস হারানো। কিন্তু সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো—যাঁরা আমাদের জ্ঞানের পথ দেখান, তাঁদের রাত কাটছে খোলা আকাশের নিচে, পুলিশের ধাক্কায়, লাঠিচার্জে।

আমাদের অন্তরে কেবল ক্ষোভ নয়—লজ্জাও জমে আছে। কারণ, আমরা এমন এক রাষ্ট্রে বাস করছি যেখানে শিক্ষককে তাঁর ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় বসতে হয়।

এ সংকটের সমাধান কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইল ঘেঁটে আসবে না; লাগবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নীতিনির্ধারণে স্পষ্ট অগ্রাধিকার। শিক্ষক আন্দোলনকে উপেক্ষা করলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। শুধু শিক্ষার মান নয়, সামাজিক বন্ধন, নৈতিক মূল্যবোধ, ভবিষ্যৎ উন্নয়ন—সবই এর ধাক্কায় নড়বড়ে হয়ে পড়বে।

শিক্ষককে রাজপথে রেখে কোনো দেশের উন্নয়ন সম্ভব না। শিক্ষককে তার প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার দিলে তিনি জাতিকে আলোকিত করবেন, আর যদি তাঁকে অপমান করা হয়, তাহলে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ।

আমাদের একটাই দাবি—শিক্ষককে রাজপথ থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনুন। সেটি সম্ভব কেবল ন্যায্য দাবিগুলো পূরণ করলেই।

শিক্ষক কেবল পেশাজীবী নন; তিনি জাতির নির্মাতা। যে দেশে শিক্ষককে তাঁর অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে বসতে হয়, সেটি কোনো সভ্য রাষ্ট্রের পরিচায়ক হতে পারে না। শিক্ষকদের অপমান মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।

আমরা শিক্ষার্থী হিসেবে লজ্জিত, ব্যথিত—তবু আশাবাদী যে রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত জাগ্রত হবে। শিক্ষককে মর্যাদা দেবে, তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। কারণ, “শিক্ষক বাঁচলে তবেই শিক্ষা বাঁচবে, শিক্ষা বাঁচলে তবেই জাতি এগোবে।”

লেখা: শিক্ষার্থী, একাদশ শ্রেণি।

শিক্ষাবার্তা /এ/১৪/১০/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading