।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা—এই তিনটি শব্দ বারবার উচ্চারিত হয় যখন রাষ্ট্র ও গণমাধ্যমের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এমন একটি সময় চলছে যখন ক্ষমতার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি ভাগ্য বদলে যাচ্ছে কিছু মানুষের। এমনকি যাদের এক সময় সংসার চালানোরও কষ্ট হতো, তারাই আজ দেশের ব্যয়বহুল বেসরকারি টেলিভিশনের মালিক। বিষয়টি শুধু বিস্ময়করই নয়—এটি গণমাধ্যমের ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ংকর বার্তাও বটে।
সম্প্রতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল তার বক্তব্যে এমন এক বাস্তবতাকে সামনে এনেছেন, যা এ দেশের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই টের পাচ্ছে—কিন্তু কেউ উচ্চস্বরে বলতে সাহস পায় না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘সংসার চালাতে পারত না আগে তারা, আজ টেলিভিশনের মালিক হয়ে গেছে।’ শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেছেন—“টেলিভিশন চালাতে গেলে নিয়ম আছে। প্রোপার্টি, ইনকাম ট্যাক্স, ব্যবসার হিসাব দেখাতে হয়। এরা কিভাবে দেখাল?”
এই প্রশ্ন আসলে শুধু সাংবাদিক মাসুদ কামালের নয়—এটি আজ গোটা জাতির প্রশ্ন।
বাংলাদেশে টেলিভিশনের লাইসেন্স পাওয়া কোনো সহজ বিষয় নয়। এটি কোনো ব্যক্তিগত দোকানের ট্রেড লাইসেন্স নয় যে ২ দিনে পাওয়া যাবে। এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। আবেদন, যাচাই-বাছাই, আর্থিক সক্ষমতার প্রমাণ, ট্যাক্স রেকর্ড, বিনিয়োগ কাঠামো, কন্টেন্ট প্ল্যানিং—সব মিলিয়ে এটি একটি বড় ধরণের আর্থিক ও নীতিগত প্রতিশ্রুতির বিষয়।
তবে বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার মসনদের কাছাকাছি থাকা কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই সব নিয়ম যেন কেবল কাগজে-কলমেই আছে। সাধারণ উদ্যোক্তা বছর বছর ঘুরে অনুমোদন পান না, কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকলে সপ্তাহখানেকেই হয়ে যায় ‘টেলিভিশনের মালিকানা’। এমন উদাহরণই তুলে ধরেছেন মাসুদ কামাল—তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইটি টিভি অনুমোদনের ঘটনা।
এদের মধ্যে কেউ একজন ছিল একটি পত্রিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার। বেতন ১০-১২ হাজার টাকা। আরেকজন ছিল একটি ইংরেজি পত্রিকার নিম্ন পদে কর্মরত। প্রশ্ন জাগে—এমন আর্থিক অবস্থায় থাকা কেউ কীভাবে কোটি কোটি টাকার টেলিভিশনের মালিক হয়?
উত্তর আসলে সহজ—তারা নিজের টাকায় টেলিভিশন খুলেনি, খুলেছে রাজনৈতিক প্রভাব, সম্পর্ক ও সুবিধা নিয়ে।
গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যখন সেই গণমাধ্যমের মালিকানা রাজনৈতিক দল বা দলের আশ্রয়ে থাকা কিছু ব্যক্তি দখল করে নেয়, তখন গণমাধ্যম আর গণমাধ্যম থাকে না—তা হয়ে পড়ে রাজনৈতিক মেগাফোন।
একজন সাধারণ উদ্যোক্তা যদি একটি বেসরকারি টেলিভিশন খোলার চেষ্টা করেন, তবে তাকে প্রথমেই দেখাতে হবে বিনিয়োগের উৎস। একটি মাঝারি আকারের টেলিভিশন পরিচালনায় ন্যূনতম বিনিয়োগ লাগে কয়েকশো কোটি টাকা। শুধু স্টুডিও ও টেকনিক্যাল সেটআপেই কোটি কোটি টাকা খরচ হয়।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—এই সাংবাদিকেরা বা তাদের গোষ্ঠী এই অর্থ কোথা থেকে পেল? কি তারা কোনো ব্যবসা করতেন? ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন?নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তি বা রাজনৈতিক আশ্রয়ে তারা বিনা বাধায় অনুমোদন ও অর্থ পেয়েছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর জনগণ পাওয়ার অধিকার রাখে। কারণ, এটি কেবল একজনের ব্যক্তিগত ব্যবসা নয়—একটি টেলিভিশন হলো তথ্য ও প্রভাবের এক বিশাল প্ল্যাটফর্ম।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় কথা বলা হয়। কিন্তু যখন টেলিভিশনের লাইসেন্স বণ্টনের বিষয়টি আসে, তখন সব স্বচ্ছতা উধাও হয়ে যায়। এই লাইসেন্স বণ্টন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক তোষামোদের হাতিয়ার। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বা তাদের ঘনিষ্ঠরা পেয়ে যায় এই লাইসেন্স, আর যাদের পিঠে রাজনৈতিক হাত নেই, তারা বছরের পর বছর শুধু দরখাস্ত জমা দেয়—ফল পায় না।
এই প্রক্রিয়া কেবল দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করে না, এটি ধীরে ধীরে একটি একদলীয় প্রচারযন্ত্রে পরিণত করে দেশের মিডিয়া কাঠামোকে। গণমাধ্যম হয়ে পড়ে আর জনগণের নয়, হয়ে পড়ে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ‘রাজনৈতিক ব্যবসা’।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। মাসুদ কামালের ভাষায়, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কয়েকদিন আগেই বলেছেন—‘আমরা নতুন কোনো টেলিভিশনের অনুমোদন দিচ্ছি না।’ অথচ মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইটি টিভি চ্যানেলের অনুমোদন দেওয়া হলো।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনুমোদনের পেছনে কী ঘটেছে? কে বা কারা চাপ দিয়েছে? কোন নথিতে ‘না’ থেকে হঠাৎ ‘হ্যাঁ’ হয়ে গেল?—এই প্রশ্নের জবাব জনগণ জানতে চায়। কারণ, তথ্য মন্ত্রণালয় জনগণের করের টাকায় পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যক্তিগত কোম্পানি নয়।
স্বাধীন গণমাধ্যম একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাণ। কিন্তু যখন এই গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক স্বার্থে চলে যায়, তখন সংবাদ আর সংবাদ থাকে না—তা হয়ে পড়ে ঘোষণাপত্র, প্রচারযন্ত্র, প্রপাগান্ডা মেশিন।
ফলশ্রুতিতে—সত্যের বদলে জনগণ পায় সাজানো স্ক্রিপ্ট।সাংবাদিকতা পরিণত হয় রাজনৈতিক তাবেদারিতে।পেশাদার সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো ঢেকে দেওয়া হয়।
এভাবে এক সময় সংবাদমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে—আর সেটাই স্বৈরাচারী শাসনের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা।
মাসুদ কামাল তার বক্তব্যে বলেছেন—“এ কারণেই তারা সেফ এক্সিট খুঁজছেন।”
এই ‘সেফ এক্সিট’ আসলে রাজনৈতিক নিরাপত্তা জাল। যারা ক্ষমতার আশ্রয়ে থেকে অনৈতিকভাবে সুবিধা নিয়েছে, তারা জানে—একদিন এই ক্ষমতা থাকবে না। তাই আগেভাগে তারা নিজেদের জন্য ‘নিরাপদ অবতরণ পথ’ তৈরি করে। টেলিভিশনের লাইসেন্স, জমি, ব্যাংক ঋণ, বিদেশে সম্পদ—সবই সেই সেফ এক্সিটের অংশ।
আগামীতে যদি কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তবে এই স্বজনপ্রীতি, লাইসেন্স বাণিজ্য ও দুর্নীতির জন্য দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।কারা লাইসেন্স পেল। কীভাবে অর্থের উৎস দেখাল?কতটা নিয়ম ভাঙা হয়েছে?কার নির্দেশে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জনগণকে জানাতে হবে—কারণ জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।
আগে জনগণ এসব ঘটনা জানত না বা জানলেও চুপ থাকত। কিন্তু এখন যুগ বদলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, বিকল্প সংবাদমাধ্যম ও সচেতন নাগরিক সমাজ এইসব গোপন প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে নিয়ে আসছে।
“১০ হাজার টাকার চাকরি থেকে টেলিভিশন মালিক”—এই বাক্যটি এখন আর নিছক অভিযোগ নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিচয় টাকা-পয়সার চেয়েও বড়, সেই রাষ্ট্রে ন্যায্য প্রতিযোগিতা টিকতে পারে না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মালিকানা ও লাইসেন্স বণ্টনের পদ্ধতিতে যদি মৌলিক সংস্কার না আনা হয়, তবে ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা আরও বড় সংকটে পড়বে। গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর হাত থেকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
এর জন্য—লাইসেন্স বণ্টনে স্বচ্ছতা আনতে হবে।বিনিয়োগের উৎস প্রকাশ্যে আনতে হবে।রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কমিশন গঠন করতে হবে।গণমাধ্যমে জবাবদিহি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
“১০ হাজার টাকার চাকরি থেকে টেলিভিশন মালিক”—এই ঘটনা কোনো ব্যক্তিগত সফলতার গল্প নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি ও জবাবদিহির অভাবের নগ্ন চিত্র। এই ঘটনার জবাব শুধু একজন সাংবাদিক বা মন্ত্রণালয় নয়, পুরো রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। কারণ গণমাধ্যম কেবল তথ্যের উৎস নয়—এটি জাতির বিবেক। আর যদি এই বিবেক বিকিয়ে যায়, তবে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারায়। তাই জনগণের এই প্রশ্ন—“এই অর্থ এলো কোথা থেকে, এই লাইসেন্স মিলল কীভাবে?”—এর জবাব দিতে হবে। নইলে ইতিহাস এই নীরবতাকেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে লিপিবদ্ধ করবে।
লেখা: শিক্ষক ও গবেষক।
শিক্ষাবার্তা /এ/০৯/১০/২০২৫
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
