ঢাকাঃ দেড় যুগ পর শিক্ষার জন্য বিশেষ বিসিএস আয়োজন করছে সরকার। তবে শিক্ষার সঙ্গে স্বাস্থ্যও যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে এবার। এতে শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক পদে ৬৮৩ এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩ হাজার ৩০ জনকে এন্ট্রি পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।
শিক্ষা ক্যাডারের জন্য সর্বশেষ ২০০৬ সালে প্রভাষক নিয়োগ করা হয় বিশেষ বিসিএসে। ২৬তম ওই বিশেষ বিসিএসে ১ হাজার ৪৭ জন প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর সাধারণ বিসিএসের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হলেও শিক্ষার জন্য আলাদা বিসিএস নেওয়া হয়নি। অথচ শিক্ষা ক্যাডারের হাজার হাজার শূন্য পদে নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্টরা দফায় দফায় বিশেষ বিসিএস আয়োজনের সুপারিশ করে।
গত বছর ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ‘জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করে সরকার। এ কমিটির সভাপতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ছয় সদস্যের এ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ কমিটি গত মাসে দফায় দফায় বৈঠক করে বিশেষ বিসিএসের সুপারিশ করে।
হঠাৎ এ দুই ক্যাডারের বিশেষ বিসিএসের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘শিক্ষা বিভাগের জরুরি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৬৮৩ জন প্রভাষক নিয়োগ দিতে বিশেষ বিসিএসের আয়োজন করতে বলা হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে (পিএসসি)। দ্রুততম সময়ে এ বিসিএস আয়োজন করা হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ক্যাডারেও তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।’
শিক্ষা ক্যাডারে হাজার হাজার শূন্য পদ থাকার পরও মাত্র ৬৮৩ জনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কেন জানতে চাইলে ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘ক্যাডার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া জরুরি ও প্রয়োজনীয় সংখ্যাকেই এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষার বিশেষ বিসিএসের চাহিদা পাওয়ার পর তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে পিএসসি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম বিশেষ বিসিএস নিয়ে ক্যাডার শাখার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ কয়েকটি বিসিএস নিয়ে নানা জটিলতা থাকলেও শিক্ষার এ বিশেষ বিসিএস নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।
সারা দেশের সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকের তীব্র সংকট। অনেক কলেজে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক না থাকায় দিনের পর দিন ক্লাস বন্ধ থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দফায় দফায় চিঠি দিলেও এর সমাধান হচ্ছে না। প্রতিটি সাধারণ বিসিএসে যেসব ক্যাডারে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হয়, তাদের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। তারপরও শিক্ষকের সংকট কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকা আর বিভাগীয় শহরের বড় বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব কলেজেই শিক্ষক সংকট রয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি কলেজে গড়ে ২৫ শতাংশ শিক্ষক নেই। বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে শিক্ষক সংকটে ক্লাস নেওয়াটাই কঠিন। ফলে পরীক্ষার আগে সিলেবাস শেষ করতে পারে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সংকটে ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিও বাড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘গাইবান্ধা সরকারি কলেজে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, প্রভাষকের পদ আছে ৮১টি। এর মধ্যে ২৫ জনের পদই শূন্য। দীর্ঘদিন ধরে এসব পূরণের জন্য তাগাদা দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাংলা, ইংরেজি বিভাগে দুটি করে পদ শূন্য রয়েছে। অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানই নেই।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ৬৬৩টি সরকারি কলেজ আছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যা ব্যুরো ব্যানবেইসের তথ্য বলছে, বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোতে প্রতি শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী আছেন ৯৭ জন, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে দেশে সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ছিল ১:৭৯।
এদিকে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য ৩ হাজার ৩০টি সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে তৈরির প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অধ্যাপক ১৫০টি, সহযোগী অধ্যাপক ৮৫০টি ও ২ হাজার ৩০টি সহকারী অধ্যাপক পদ তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেও এ প্রস্তাবে অনুমোদন পাওয়া গেছে।
শিক্ষার মতো সংকট স্বাস্থ্যসেবাও। দেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকসহ সরাসরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত ২৭ শতাংশ পদ ফাঁকা। প্রথম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত এ ধরনের অনুমোদিত পদ ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮২৮টি। এর মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৬১ জন। ৬৩ হাজার ৫৭১টি পদ শূন্য। তবে গ্রামাঞ্চলে এ ফাঁকা পদের হার ৪০ শতাংশ। চিকিৎসক ঘাটতি এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। অনুমোদিত পদের বিপরীতে সাধারণ চিকিৎসকের ঘাটতি ২৫ শতাংশ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি ৫৮ শতাংশ।
এদিকে ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম বিসিএসের জাটিলতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে পিএসসি। ৪৩তম বিসিএসে চূড়ান্ত ফলাফলের পরও বাদ পড়েছেন ২৬৭ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলন করছেন নিয়োগ পেতে।
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এক ধাপের পরীক্ষা শেষ। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হবে ২০ মে আর শেষ হবে আগামী ২৪ জুন। ৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল সামনের মাসেই প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে পিএসসি। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা চলছে। ৮ মে শুরু হওয়া এ পরীক্ষা শেষ হবে ১৯ মে। ৪৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবে আগামী ৮ আগস্ট।
পিএসসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, গত কয়েক বছর জুড়েই শিক্ষার জন্য বিশেষ বিসিএস আয়োজনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সফল হওয়া যায়নি। এখানে আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্বও একটি কারণ। যাই হোক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা পিএসসি হলে এ সংকট থাকবে না। কিন্তু যতদিন আলাদা পিএসসি না হয়, ততদিন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এ দুটি সেক্টরে পিছিয়ে পড়লে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১২/০৫/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.