এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি : পরিকল্পনা উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক।। প্রাথমিক শিক্ষা একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এজন্য উন্নত দেশগুলোয় প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশেও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নের গত এক যুগে দুইটি বৃহত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, যাতে ব্যয় হয় ৩৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৬৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

কিন্তু এর সুফল আসেনি। ঠেকানো যায়নি প্রাথমিক শিক্ষার মানের অবনতি। শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট-২০২২’ অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় দুর্বল।

এছাড়া তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতের দক্ষতায় দুর্বল। তাদের গণিতের দক্ষতা তৃতীয় শ্রেণির উপযোগী নয়। শিক্ষাবিদরা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের পদ্ধতি ও পরীক্ষা নিয়ে অনেক শোরগোল তোলা হলেও শিক্ষার মানের অবনতি ঠেকানো যায়নি।

অবকাঠামো নির্মাণ আর শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে গুরুত্ব দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারছে, সে বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। শিক্ষার্থী বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। প্রাথমিক স্তরে হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করা যায় না।

এছাড়া শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যার অনুপাত কম, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অভাব, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এবং অপর্যাপ্ত তহবিল প্রাথমিক শিক্ষার মান ক্রমবনতি জন্য দায়ী। সরকারের নীতিনির্ধারক ও শিক্ষার অভিভাবকরাও শিক্ষার দুরবস্থার কথা জানেন; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেন না।

‘প্রাথমিক শিক্ষায় সব শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করার লক্ষ্য সামনে রেখে ২০১১ সালে তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৩) শুরু করে সরকার। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন হওয়া এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ১৮ হাজার ১৫৩ কোটি ৮৮ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী সুশাসন নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখন ও শেখানোর গুণমানের উন্নয়ন, সর্বজনীনভাবে বিস্তৃত একটি সুষ্ঠু সমতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সরকার ২০১৮ সালে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-৪) কার্যক্রম শুরু করে।

২০২২ সালের জুলাইয়ে সম্পন্ন হওয়া এ প্রকল্পে ১৫ হাজার ৩১৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিপুল ব্যয়ের এই দুইটি প্রকল্প শেষে শিক্ষার্থীদের দক্ষতামানেরও উন্নতি হওয়ার কথা ছিল। তবে এসব প্রকল্প শেষে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানে কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে সেই তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষার্থীদের অর্জিত দক্ষতার স্তর নির্ণয়ে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বাংলা ও গাণিতিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করে দুই বছর পর পর জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এ প্রতিবেদন তৈরি করে। সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বাংলায় ও ৩৯ শতাংশ গণিতে শ্রেণি বিবেচনায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দক্ষতা অর্জন করেছে।

পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে বাংলায় এ হার ৫০ ও গণিতে ৩০ শতাংশ। ২০১১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ বাংলায় ও ৫০ শতাংশ গণিতে শ্রেণি অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দক্ষতা অর্জন করেছিল। আর পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে বাংলায় এ হার ছিল ২৫ আর গণিতে ৩৩ শতাংশ। সে অনুযায়ী প্রায় এক যুগে শ্রেণি বিবেচনায় কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনের দিক থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে বাংলায় এ হার কমেছে ১৬ শতাংশীয় পয়েন্ট। গণিতের ক্ষেত্রে পারফরম্যান্সে অবনতির মাত্রা ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট। পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে বাংলায় পারফরম্যান্সে উন্নতি হলেও গণিতে অবনতির মাত্রা ৬ শতাংশীয় পয়েন্ট।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন দৃশ্যমান। তবে সেই অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার মান বাড়ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি ময়মনসিংহের টাউন হল তারেক স্মৃতি অডিটোরিয়ামে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও মানের ভয়াবহ অবনতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, দেশের শিক্ষায় অনেক কিছুই হয়েছে। অনেক প্রসার ঘটেছে। রমরমা অনেক বাণিজ্যও দেখা যাচ্ছে। তবে শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে এবং ঘটছে। এটা আশঙ্কাজনক। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষক বলেন, ‘স্বাধীনতার পর প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের তোড়জোড় চলেছে। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে কাউকে কার্যকর ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গত এক যুগে দেশে শিক্ষা খাতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার প্রায় সবই ছিল রাজনৈতিক। শিক্ষার মানের উন্নয়নের জন্য দরকার শিখন-শেখানোর গুণমানের উন্নয়ন। অথচ আমাদের দেশে জোর দেওয়া হয়েছিল অবকাঠামোগত উন্নয়নে।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার নিয়ে কাজ করা হয়েছে। শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও বেড়েছে। কিন্তু তারা ক্লাসে কতটা শিখছে, সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়নি। এমনকি শিক্ষার্থীরা কতটা শিখছে বা দক্ষতা অর্জন করছে, সে বিষয়ে মনিটরিং নেই। মনিটরিং আছে ক্লাসে উপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বেঞ্চের সংখ্যা এসব বিষয়ে।’ শিক্ষক নেতারা বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম হওয়ার বিষয়টিরও এখানে বড় প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকরা এখনো ১৩তম গ্রেডে বেতন পান। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও মানসম্পন্ন নয়। ফলে শ্রেণিকক্ষে কাঙ্ক্ষিত মানের পাঠদানও নিশ্চিত হয় না। 

শিক্ষাবার্তা /এ/০৩/০৪/২০২৫

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading