ঢাকাঃ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের রুটিন দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরীর চাকরির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে আগামী ১৯ জানুয়ারি। এজন্য শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে বসতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। এ দৌড়ে জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এগিয়ে আছেন যথাক্রমে- তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রায়হান বাদশাহ, আফরোজা বেগম, সমীর কুমার রজক দাস, মো. মিনহাজুল হক, মো. তারেক আনোয়ার জাহেদী ও জালাল উদ্দিন চৌধুরী।
জানা যায়, ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রায়হান বাদশাহকে প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠতার তালিকায়ও প্রথমে থাকায় রায়হান বাদশাহ প্রধান প্রকৌশলীর পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু সবার কনিষ্ঠ জালাল উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দিয়ে কৌশলে রায়হান বাদশাহকে ওএসডি করা হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার জন্য রায়হান বাদশাহ সবার চেয়ে এগিয়ে থাকার পরও এখন আইনি জটিলতায় পড়েছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রায়হান বাদশাহকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি না দেওয়ার জন্য কৌশলে ওএসডি করা হয়েছে।
এছাড়া ৫ আগস্টের পর প্রায় তিন মাস প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্বে ছিলেন রায়হান বাদশাহ। জালাল উদ্দিন চৌধুরীর আগে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপর দায়িত্ব পেয়ে নতুনভাবে আর্থিক ক্ষমতা পুনঃঅর্পণ, নীতিমালা প্রণয়ন ও অর্গানোগ্রাম প্রস্তুতসহ বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ হাতে নেন রায়হান বাদশাহ। এসব উদ্যোগের ফলে বিশেষ সিন্ডিকেটের স্বার্থে আঘাত হানায় এসব তৎপরতা বাধাগ্রস্ত করতে রায়হান বাদশাহর বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ এনে সরব হন অনেকে। পরে তিনি ওএসডি হয়ে যান। বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসন্তোষও ইইডিতে অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে।
আর্থিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করে ইইডির সেবা কার্যক্রম সহজীকরণ করার জন্য ইইডির ঠিকাদার এবং মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের হাতে যেন আর্থিক ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগের আমলে গত ১৫ বছরে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে নতুন করে ক্ষমতা ও আর্থিক বিষয়াদি পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বহু কর্মকর্তা ও ঠিকাদার। ইইডির নতুন কাঠামোতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সমন্বয়ে গঠিত ৯টি সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বেড়েছে। অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দিন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন কাজ প্রধান প্রকৌশলীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকায় অঞ্চল বা সার্কেলভিত্তিক কাজে কোনো গতি ছিল না। তাই কাজের গতি বাড়িয়েছে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে নতুন এই উদ্যোগের ফলে।
সূত্র জানায়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর একক নিয়ন্ত্রণে থাকা আর্থিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম এটি। এরই মধ্যে আর্থিক ক্ষমতার পুনঃঅর্পণ (সাব-ডেলিগেশন অব ফাইনান্সিয়াল পাওয়ার) বা বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় একটিসহ মোট ৬৫টি নির্বাহী প্রকৌশলীর এবং আটটি বিভাগে আটটি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় একটিসহ মোট ৯টি সার্কেল অফিস রয়েছে যেখান ৯ জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কর্মরত আছেন। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে সহকারী প্রকৌশলী এবং উপজেলা পর্যায়ে উপসহকারী প্রকৌশলীদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে উন্নয়ন কাজগুলো বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। মূলত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের আওতায় যাবতীয় শিক্ষা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি পরিপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। আর এই বিভাগের মাধ্যমেই মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর নানা ধরনের কাজ সম্পাদন হয়ে থাকে।
বর্তমানে আর্থিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করার ফলে মাঠ পর্যায়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীরা আট কোটি টাকা এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা পাঁচ কোটি টাকা ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দরপত্র অনুমোদন করতে পারবেন। আর এতে কাজের গতিশীলতার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীদের মধ্যে অসন্তোষ দূর করা সম্ভব হবে। উন্নয়ন কাজেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
শিক্ষা প্রকৌশলের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ দিন প্রধান প্রকৌশলীর একক ক্ষমতার কাছে জিম্মি ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট যেমন গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও ইইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের কোনো আর্থিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
অর্গানোগ্রাম প্রস্তুত
এতদিন প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত অর্গানোগ্রাম ছাড়াই চলত। ফলে কাজে অনেক সময় স্থবিরতা দেখা দিত। ৫ আগস্টের পর অর্গানোগ্রাম প্রস্তুতের কাজ শুরু হয় এবং ২১ নভেম্বর ইইডির ২২টি শাখা বা দপ্তরে ভাগ করে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত হয়।
নির্দেশিকা তৈরির উদ্যোগ
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে রাজস্ব বাজেটের আওতায় সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সম্প্রসারণ, মেরামত ও সংস্কার কিংবা আসবাবপত্র সরবরাহ কাজের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের লক্ষ্যে নির্দেশিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় সরকার পরিবর্তনের পর। এ উদ্যোগের কারণেও স্বার্থান্বেষী বিশেষ মহলের চক্ষুশূল হন রুটিন দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী।
গত ৫ আগস্টের পর দেশে পরিবর্তিত সময়ে ২৫ আগস্ট ইইডির জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রায়হান বাদশাকে প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়। রায়হান বাদশা দায়িত্ব প্রাপ্তির পরপরই আর্থিক ক্ষমতা পুনঃঅর্পণ, নীতিমালা প্রণয়ন ও অর্গানোগ্রাম প্রস্তুতসহ বেশ কিছু কাজে হাত দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ২৬ সেপ্টেম্বর অনুমোদন দেয় এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ২২ অক্টোবর মোতাবেক মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে যায়। আর্থিক ক্ষমতা মাঠপর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ করায় নিজেদের অপকর্মের পথ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় কিছু প্রকৌশলী অধিদপ্তরের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াসে লিপ্ত হন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রকৌশলী জানান বর্তমানে রুটিন দায়িত্বে থাকা রায়হান বাদশা দীর্ঘদিন বঞ্চিত একজন প্রকৌশলী। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাকে সৈয়দপুরের বিহারি এবং ছাত্রজীবনের বিশেষ তকমা লাগিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এমনকি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদটি খালি থাকলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। পরে ২০ নভেম্বর রায়হান বাদশাহকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়।
ইইডির প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এটি আসলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বসানোর কোনো পদ নয়, এখানে যাকে যোগ্য মনে করে সরকার তাকেই বসায়। আমার ক্ষেত্রেও জ্যেষ্ঠতার নীতি মানা হয়নি। উপদেষ্টা এবং শিক্ষা সচিব মহোদয় যাকে উপযুক্ত ও যোগ্য মনে করবেন তাকেই বসাবেন।’
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৬/০১/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.