ঢাকাঃ পেনশন মানেই টেনশন, সীমাহীন ভোগান্তি। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে জীবনের প্রায় পুরোটা সময় পার করেছেন যেসব শিক্ষক, বৃদ্ধ বয়সে তাদের বেশির ভাগেরই এখন দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। কর্মজীবন শেষে নিজেদের প্রাপ্য অবসরকালীন সুবিধা বুঝে নিতে গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। টাকা না পেয়ে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না, দারিদ্র্যের জালে আটকে হাজারো পরিবার। অনেক পরিবারের দিন কাটছে অর্ধাহারে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ হলো, অবসর নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ সুবিধা বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে ৬৮ হাজার আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ঝুলে আছে চার বছর ধরে। পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবের কথা শুনিয়ে দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবেদনকারী সব শিক্ষক-কর্মচারীর ভাতা পরিশোধে দরকার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব শাহজাহান আলম সাজু পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে পলাতক রয়েছেন অবসর বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরভাতার গুরুত্বপূর্ণ ফাইলও আটকে আছে। এতে দিনদিন ভোগান্তি আরও বাড়ছে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে অবসর সুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়ে শিক্ষক নেতারা বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে এমনিতেই বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকা পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। এখন সরকার পরিবর্তনের পর অবসর সুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন না করায় এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। কারণ বিগত সরকারের আমলে গঠিত বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা অফিস করছেন না। দিন যত যাচ্ছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর সুবিধার টাকা পেতেও অপেক্ষার সঙ্গে কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়ছে।
জীবদ্দশায় অনেকের কপালে জোটে না অবসর ভাতা: রাজধানীর নীলক্ষেতে ব্যানবেইস ভবনে অবস্থিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং অবসর সুবিধা বোর্ডে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষকরা আসছেন তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে। নওগাঁর পত্নীতলা থেকে শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে বিধবা মেয়ের স্বামীর পেনশনের টাকা তুলতে এসে বয়োবৃদ্ধ বাবা জানান, তারিখের পর তারিখ, নথির পর নথি দিলেও ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স শূন্য। অনলাইনে আবেদন করার পর কেটেছে চার বছর। তবে একটি টাকাও ছোঁয়ার ভাগ্য হয়নি। কুড়িগ্রামের রৌমারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক মিজানুর রহমান অবসরে গেছেন ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর। পরের মাসে তিনি অবসর ভাতা পেতে আবেদন করেন। ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। মিজানুরের স্ত্রী জাহানার খাতুন স্বামীর অবসর ভাতার জন্য অবসর বোর্ডের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
নারায়ণগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ জয়নুল আবদীন ২০২০ সালে অবসরে গেছেন; কিন্তু পাননি পেনশন। নওগাঁর মান্ডার আক্কাস আলী কবিরাজ ১৯৯৪ সাল থেকে মফস্বলের হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে ২০২০ সালে অবসরে যান; কিন্তু এখনো পাননি পেনশনের টাকা। মফস্বলের একটি কলেজের অফিস সহকারী খোরশেদ আলমও তিন দশকের কর্মজীবন শেষে এমন সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘সংসারটা এখনো আমার ওপর নির্ভরশীল। যা-ই কিছু পাই, সেটা যদি পেয়ে যেতাম, তবে ছেলের জন্য কিছু একটা করতে পারতাম। আর এর মাধ্যমেই তাকে দিয়ে সংসারের হাল ধরাতে পারতাম।’
রাজবাড়ীর মাজবাড়ি জাহানারা বেগম কলেজের অধ্যক্ষ আসাদুজ্জামান মিয়া ২০১৮ সালে অবসরে যান। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ১৭ মে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত পাননি পেনশনের টাকা। বাবার মৃত্যুর পর ছেলে নাফিস এখন ২০২৪ সালে এসে চক্কর কাটছেন বাবার প্রাপ্য টাকা তুলতে। তাকে জানানো হয়, ২০২৫ সালের শেষ দিকে শুরু হবে সেই প্রক্রিয়া। পঞ্চগড়ের আটোয়ারি থেকে মোজাম্মেল হক এসেছেন ক্যানসার আক্রান্ত ভাইয়ের পেনশনের টাকা তুলতে। এদিকে স্বামীর মৃত্যুর পর তার পেনশনের টাকা তুলতে এসে চট্টগ্রামের রাউজানের এক ভুক্তভোগী জানালেন, তাকে নাকি বহু আগেই চেক দেওয়া হয়েছে। তবে তার দাবি তিনি কোনো চেকই পাননি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক শাহ মো. সাদীদুল ইসলাম অবসরে গেছেন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। স্ট্রোক করে এখন তিনি বেশ অসুস্থ। এরপর চিকিৎসার কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন। তারপরও টাকা পাচ্ছেন না।
কত টাকা দরকার :সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ৫ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণ সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে। রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে এ দুটি প্রতিষ্ঠান অবস্থিত।
জানা গেছে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আবেদন করে অবসর ভাতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা দেওয়া আবেদনগুলোর নিরীক্ষা (অডিট) নিষ্পত্তি করা হয়েছে। কিন্তু তহবিলের অভাবে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত জমা হওয়া আবেদনগুলোর বিপরীতে অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে, কল্যাণ সুবিধার জন্য প্রায় ৩১ হাজার আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ১০ হাজার ২৪২টি।
শিক্ষকদের কাছ থেকে কাটা হয় বেতনের ১০ শতাংশ :অবসর ও কল্যাণ সুবিধার টাকার বড় একটি অংশ নেওয়া হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকেই। অবসর সুবিধার জন্য চাকরিকালীন তাদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা মাসে কেটে রাখা হয়। কল্যাণ সুবিধার জন্য কাটা হয় মূল বেতনের ৪ শতাংশ। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসরের জন্য ও ৩০ টাকা কল্যাণের জন্য) নেওয়া হচ্ছে। বাকি টাকা সরকারি তহবিল ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। জানা গেছে, নিয়মিতভাবে এই তহবিলে কোনো বাজেট দেয়নি সরকার। মাঝেমধ্যে থোক বরাদ্দ হিসেবে সহায়তা দেওয়া হয়। অবসর সুবিধা হিসেবে এক জন শিক্ষক গড়ে ১২ লাখ টাকা এবং এক জন কর্মচারী ৬ লাখ টাকা করে পেয়ে থাকেন। কলেজের অধ্যক্ষ সর্বোচ্চ ৩৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পান। এতে অবসর বোর্ডে বছরে প্রয়োজন হয় ১ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা; কিন্তু আয় হয় ৮৭৬ কোটি টাকা। এতে বছরে ঘাটতি থাকে ৫০৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে কল্যাণ ট্রাস্টে শিক্ষকরা গড়ে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। এ সংস্থায় প্রতি মাসে গড়ে আবেদন জমা পড়ে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার। প্রতি মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৬৫ কোটি টাকা। এমপিওর ৪ শতাংশ হারে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে আয় আসে ৫০ কোটি টাকা। এফডিআরের লভ্যাংশ থেকে আয় হয় ২ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ১৩ কোটি টাকা।
কল্যাণ ট্রাস্টে দায়িত্ব পালনকারী এক জন কর্মকর্তা বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর যেসব আবেদন জমা আছে, তা নিষ্পপ্তি করতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। অবসর বোর্ডের এক জন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের প্রতি মাসে আবেদন অনুযায়ী চাহিদা রয়েছে ১১৫ কোটি টাকা। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীর মূল বেতন থেকে প্রতি মাসে ৬ শতাংশ অর্থ কেটে আয় হয় ৭৩ কোটি টাকা। এতে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৩৯ কোটি টাকা। আবেদনের জট পড়েছে ৩৭ হাজারের মতো। এটি নিষ্পত্তি করতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রতি অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত যায়। এই বাজেট থেকে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা অবসর বোর্ডের জন্য রাখা হলে এ ঘাটতি আর থাকবে না।
শিক্ষক নেতারা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক ব্যাংকের তহবিল লোপাট করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার কারণেই আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের রাস্তায় রাস্তায় যেন ঘুরতে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তারা।
প্রসঙ্গত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে অনলাইনে পেনশন আবেদন, হাজিরা প্রদান ও ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবে পেনশনের টাকা স্থানান্তর চালু রয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৮/১০/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.