কেন এমনটি হয়?
বলা হয়, এটি হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনের ভূত। মগজে শাসনের ভূত। আমাদের দেশের লোকেরা দায়িত্ব বা ক্ষমতা পেলেই শাসন করতে চায়। বিশেষ করে যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকে। যে কারণে জনপ্রতিনিধি, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হন কিংবা মন্ত্রী—তাদের স্যার বলার কোনও রেওয়াজ নেই এবং তাদের স্যার না বললে তারা মাইন্ডও করেন না। কিন্তু খুব ব্যতিক্রম না হলে একজন ইউএনও সাহেবও স্যার না শুনলে মনে করেন সেবাগ্রহীতা জনগণ বোধহয় তাকে সম্মান দিচ্ছে না। অর্থাৎ জনগণ তাকে সম্মান দিলো কী দিলো না, সেটি নির্ভর করছে স্যার ডাকার ওপরে। এটি তার চিন্তার সীমাবদ্ধতা। বোধের বিকার।
সরকারি কর্মকর্তাদের কারা স্যার বলতে চান না?
প্রধানত দুই পেশার মানুষ কাউকে স্যার বলতে চান না। এক. সাংবাদিক, দুই. শিক্ষক। পেশাগত কারণে সাংবাদিকদের সঙ্গে যেহেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এমনকি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারেরও ব্যক্তিগত পরিচয় থাকে, সখ্য থাকে এবং এরকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তারা যেহেতু ভাই ও আপা সম্বোধন করেন, ফলে সাংবাদিকরা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ‘স্যার’ বলতে চান না। এখানে সাংবাদিকদের ইগো এবং ক্ষমতাচর্চার বিষয়টিও কাজ করে। এটি রাজধানীকেন্দ্রিক এবং মূলধারার পরিচিত সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। কিন্তু জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকরা সাধারণত ডিসি, এসপি এবং ইউএনওদেরও স্যার বলেন। যেহেতু অধিকাংশ সাংবাদিকই ‘স্যার’ বলেন, ফলে তাদের মধ্যে কেউ যখন ‘স্যার’ না বলেন, তখনই জটিলতা সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ সবসময় ‘স্যার’ শুনে অভ্যস্ত অফিসারের তখন এটি গায়ে লাগে। তিনি মনে করেন, ওই সাংবাদিক বা শিক্ষক বা অন্য কোনও পেশার মানুষটি বোধহয় তাকে সম্মান দিচ্ছেন না। অর্থাৎ ‘স্যার’ শব্দের উৎপত্তি যা-ই হোক না কেন, তিনি এটিকে সম্মানসূচক মনে করেন এবং কেউ তাকে ‘স্যার’ না বললেই তিনি রেগে যান। এই রেগে যাওয়ার পেছনে আছে তার নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবা এবং সংবিধান ও আইনবলে তিনি যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, অর্থাৎ জনগণের সেবা করাই যে তার মূল কাজ—সেটির বিস্মৃতি।
যে জনগণের করের পয়সায় তার বেতন হচ্ছে, সেই জনগণকে যেভাবে সম্মান করা উচিত ছিল, প্রশাসনের কর্তারা ঠিক সেটির বিপরীতে হাঁটেন। তারা বরং জনগণকেই তাদের প্রজা ভাবেন। জনগণকে প্রজা ভাবার এই মানসিকতার পেছনে রয়েছে ব্রিটিশ কলোনিয়াল ভূত। অথচ সেই ব্রিটেনেও সরকারি কর্মচারীদের এভাবে স্যার বলার রেওয়াজ নেই। কেউ চাইলে স্যার বলতে পারেন, নাও বলতে পারেন। কিন্তু স্যার না বলায় তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে—এরকমটি শোনা যায়নি।
তাহলে সমাধান কী?
সমাধান খুব সহজ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে বলে দিতে পারে যে সরকারি অফিসে সেবা নিতে যাওয়া জনগণ কাউকে স্যার বলতে বাধ্য নন। কেউ যদি স্যার বলেন সেটি তার স্বাধীনতা। কিন্তু স্যার না বললে কারও সঙ্গে অশোভন আচরণ করা বা তাকে সেবা থেকে বঞ্চিত করা হলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী আইনেও ‘সম্বোধন’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করে বিষয়টি পরিষ্কার করা যায়।
পরিশেষে, সরকারি কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলা না বলা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এটি নিয়ে কিছু দিন পরপর যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, সেটিও অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রয়োজনীয় এবং হাস্যকর। বরং সরকারি অফিসের লোকজন ঠিকমতো জনগণকে সেবা দিচ্ছেন কিনা; সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানেও সাধারণ মানুষ বিনা পয়সায় সেবা পাচ্ছে কিনা; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকমতো কাজ করছেন কিনা; তারা কীভাবে জনগণকে হয়রানি করছেন; জনগণের করের পয়সায় গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কী পরিমাণ টাকা খেয়ে ফেলছেন—এসবই হওয়া উচিত মূল আলোচনা। রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যন্ত প্রতিটি সরকারি অফিসে এ বিষয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন হওয়া দরকার। সরকারি অফিসে সেবাদানের প্রকৃত চিত্র গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় আসতে থাকলে উল্টো তারাই জনগণকে ‘স্যার’ বলা শুরু করবেন।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।