সার্টিফিকেট পোড়ানো শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিকতা
অনিল মো. মোমিন : কয়েকদিন আগে রাজধানীর ইডেন কলেজের এক ছাত্রী সার্টিফিকেট পুড়িয়ে সরকারি দপ্তরে চাকরি পাওয়ার বিষয় দেশব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সচেতন মহলে এই সার্টিফিকেট পোড়ানো ও চাকরি পাওয়া নিয়ে তুমুল সমালোচনার পর ধারণা করা হচ্ছিল নৈতিক জায়গা থেকে সার্টিফিকেট পোড়ানোর মতো গর্হিত কাজ আর কেউ করবেন না। কিন্তু না, এটা যেন এখন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। দেশসেরা বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসব করে যাচ্ছে। কেউ সার্টিফিকেট ভিজিয়ে পানি পান করার পর সেগুলো শুকিয়ে আগুনে পোড়ায়। কেউ সার্টিফিকেট দুধে ধুয়ে সেটা দিয়ে গোসল করে। আবার কোনো কোনো গোষ্ঠী সার্টিফিকেট পুড়িয়ে আন্দোলন করে। এ ধারাবাহিকতা এখনও চলমান। মানুষের ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ কিংবা নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বাদ-প্রতিবাদ জানানো স্বরূপ বিশ্বজুড়ে নানা অভিনব উপায় আছে এটা সত্যি। তবে এত এত সার্টিফিকেট পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা বিশ্বের আর কোথাও আছে কি নাÑএই মূহূর্তে তা আমার জানা নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে ২৫-৩০ বছরে অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি-সনদ পুড়িয়ে ফেলা কোনো সাধারণ বিষয় হিসেবে দেখার সুযোগ আছে কি না, তা আলোচনার দাবি রাখে। পোড়ানোদের অভিযোগÑতারা সরকারি চাকরি পাচ্ছে না, সরকার সুযোগ দিচ্ছে না। যে ক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই কাজটি করে থাকুক না কেন কাজটি দুটো প্রশ্নের জš§ দেয়। ক. দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে তাদের অর্জিত শিক্ষা আসলে কী; খ. স্বীকৃতি পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হলে সেই শিক্ষাব্যবস্থাটাই বা তাহলে কেমন?
সনদ পোড়ানোদের অর্জিত শিক্ষা নিয়ে যে প্রশ্ন এসেছে তাতে হয়তো নানান উত্তর আছে। কেননা শিক্ষার নানান লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছেÑআচরণীয় পরিবর্তন থেকে রুটি-রুজির ব্যবস্থা পর্যন্ত। এদিক থেকে কেউ বলবেন তারা যথার্থ শিক্ষা শেষ করে কর্মোপযোগী হয়েছে। কেউ বলবেন অর্জিত শিক্ষাই হলো ওই সনদ।
শিক্ষা আসলেই কী? শঙ্করাচার্যের মতে, ‘আত্মজ্ঞান লাভই হলো শিক্ষা।’ সরলভাবে শিক্ষা হলো একটি আচরণগত পরিবর্তন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শেখার সুবিধা বা জ্ঞান, দক্ষতা, মান, বিশ্বাস এবং অভ্যাস অর্জন করা যায়। কারও মতে, শিক্ষা হচ্ছে বৃদ্ধি ও বিকাশমূলক প্রক্রিয়া। আবার কেউ বলেন, শিক্ষা সামাজিক প্রক্রিয়া, জীবনযাপনের প্রস্তুতি। যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক জন ডিউই বলেছেন, ‘শিক্ষা হলো অভিজ্ঞতার অবিরত পুনর্গঠনের মাধ্যমে জীবনযাপনের প্রক্রিয়া।’ এই ছোট্ট পরিসর থেকে এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়, শিক্ষা একদিকে যেমন আচরণিক পরিবর্তন সাধন করবে, তেমনি তা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতেও ভূমিকা রাখবে। তবে শিক্ষা এই জীবনযাপনের জন্য কোনো একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াই শুধু আমাদের শেখায় না। বরং অনেক অনেক প্রক্রিয়ার দ্বার খোলে। তাহলে তারা সার্টিফিকেট কেন পোড়াচ্ছে? বেঁচে থাকতে সার্টিফিকেট কীভাবে তাদের প্রতিবন্ধকতা হলো? এমন কর্মকাণ্ডে তাদের শিক্ষা নিয়ে দুটো সম্পূরক প্রশ্নের জš§ দেয়Ñ ১. সুন্দর জীবনযাপন করতে শুধু চাকরিই দরকার? ২. জীবিকার জন্য শুধু সরকারি চাকরিই হতে হবে?
বাস্তব সত্যি হলো প্রকৃত শিক্ষা একজন মানুষের কাছে নানান দ্বার খুলে দেয়। ঋগবেদেও এমন ইঙ্গিত আছে। সেখানে বলা আছে, শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মত্যাগী করে তোলে। দার্শনিক হার্বাট স্পেনসার বলেছেন, শিক্ষা উদ্দেশ্য হলো সামগ্রিকভাবে বাঁচার প্রস্তুতি। তাহলে যে শিক্ষা আমাদের স্বীকৃতি পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য করে সে শিক্ষা আসলে প্রকৃত শিক্ষা কি নাÑএকটা বড় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। আবার এটা একটা হিপোক্রেসিও বটে। সার্টিফিকেট পুড়িয়ে কেউ নিজেকে শিক্ষিত দাবি করছেন। অথচ চাকরি কিংবা সরকারি চাকরি ছাডা অন্য উপায় জানেন না বা খুঁজতে চান না! শিক্ষা যদি জীবনযাপনের উপায় (ধিুং ড়ভ ষরারহমং) শেখাতে না পারে, তবে কেমন শিক্ষা গ্রহণ করলাম? কী শিখলাম? কীভাবে শিক্ষিত হলাম?
উপনিষদে বলা হয়েছেÑশিক্ষা মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে তোলে। তাহলে শিক্ষিত ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে সংস্কার মুক্ত হবেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। ছোটবেলা থেকে আমরা শিখেছি, কোনো কাজই ছোট নয়। মনেপ্রাণে তা বিশ্বাসও করি। কিন্তু কাজে প্রমাণের বেলায় আমাদের যত আপত্তি! উচ্চশিক্ষার সনদধারী হয়ে আমরা নিজেদের অভিজাত শ্রেণি ভাবতে পছন্দ করি, সাহেব ভাবতে শুরু করি। ওইসব চাকরি আর বড়লোকি ছাড়া নিজেদের বেকার করে রাখি। এ যেন আহমদ ছফার সেই কথার অনুরণনÑ‘বড় নামকরা স্কুলে বাচ্চারা বিদ্যার চাইতে অহংকারটা বেশি শিক্ষা করে।’ কিন্তু এর ফলাফল কী? বেকারত্বে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আমরা সার্টিফিকেট পোড়াই। কিন্তু সার্টিফিকেট পুড়িয়ে কি আসলেই প্রমাণ করা যায় আমরা শিক্ষিত? যায় না। আর শিক্ষিত হলেও তা পোড়াতে হবে? এভাবে রাগ ক্ষোভ উগড়ে দিতে হবে? নিশ্চয়ই না। এমন প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ সমর্থন যোগ্য নয়। চাইলে বিষয়টিকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। প্রতিবাদ-ক্ষোভ কার বিরুদ্ধে? সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে নিজের খরচে কিংবা স্বল্প খরচে নেয়ার বিনিময়ে আমাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিল? রাষ্ট্র খরচ দিয়ে পড়ালো আবার রাষ্ট্রই চাকরি দিতে বাধ্য? নাগরিক হিসেবে শিক্ষিত ব্যক্তির দায় তাহলে কী? কৌটিল্যের মতে, ‘শিক্ষা হলো শিশুকে দেশ বা জাতিকে ভালোবাসার প্রশিক্ষণ দেয়ার কৌশল।’ এটা সত্যি হলে তাহলে আমাদের শিক্ষার এই ফলাফল?
‘সব কাজ, সব পেশা সম্মানজনক’ শিখে বড় হয়ে কেন যে যেকোনো কাজ করে স্বাবলম্বী হতে চাই নাÑতা এক অদ্ভুত বিষয়। উপার্জনের জন্য অনেক পথ আছেÑব্যবসা, কৃষি, উদ্যোক্তা ইত্যাদি। শুধু উচ্চ পড়াশোনার দম্ভটা ছাড়তে হবে। তাহলেই দেখব অন্য ১০ জন ব্যবসায়, কৃষি কিংবা উদ্যোক্তায় যতটা সফল আমি তার চেয়েও বেশি সফল। কারণ আমার অর্জিত শিক্ষা উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা কিংবা কৌশলে আমাকে ওদের থেকে এগিয়ে রাখবে। এভাবে সফল হওয়া শত উদাহরণ একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই পাওয়া যায়। কেননা শিক্ষার কাজ হলো মানুষকে জীবন ও জীবিকার উপযোগী করে তোলা।
দার্শনিক হার্বাট স্পেনসারও বলেছিলেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সামগ্রিকভাবে বাঁচার প্রস্তুতি।
শিক্ষা যা শেখাবে বা শিক্ষার যা উদ্দেশ্য তার প্রয়োগ ঘটানোর গুরুদায়িত্ব ব্যক্তির পাশাপাশি রাষ্ট্র তথা শিক্ষাব্যবস্থার। এই লেখার শুরুতে যে দুই প্রশ্নের অবতারণা করেছি তার দ্বিতীয়টির উত্তর একটি বৃহৎ আলোচনা। সেদিকে না গিয়ে আমরা অতি সংক্ষেপে বলতে পারি রাষ্ট্রকে এমন শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে হবে, যা হবে গুণগত মানসম্পন্ন ও কর্মোপযোগী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, ‘তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্ব সত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’ দৃশ্যত আমরা দেখি বর্তমান আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে সেটা মানুষকে চাকরির দিকে নিয়ে যায়। এতে বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়ছে হতাশা। বিকাশ ঘটছে না তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতার। ফলে এর দায় নিতে হবে কিছু শিক্ষাব্যবস্থাকেও। বর্তমানের গলদ আর সংকট কাটিয়ে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার অবারিত দ্বার খুলবে এমন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে আমাদের হীনমন্যতা ও বেকারত্ব দূর করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায় বলতে পারি, শিক্ষার উচিত তাকে উদ্যোক্তা বা চাকরি সৃষ্টিকারী হতে প্রস্তুত করা, চাকরি খুঁজতে নয়। আমরা যদি তরুণদের চাকরি সৃষ্টিকারী হিসেবে গড়ে তুলতাম, তাহলে বেকারত্ব বলে কিছু থাকত না। সবশেষে বলতে চাই এমন শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই না যা আমাদের সার্টিফিকেট পোড়াতে শেখায় কিংবা বাধ্য করে। সংশ্লিষ্ট সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়