শিক্ষা কেন সৎ-নীতিমান সৃষ্টি করতে পারছে না?
অনল চৌধুরীঃ শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু লিখতে পড়তে শেখা বা সনদ অর্জন না। এর প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন এবং অর্জিত জ্ঞান ব্যবহার করে দারিদ্র্য-দুর্নীতিমুক্ত-আইনের শাসনে পরিচালিত উন্নত দেশ-জাতি গঠন এবং বিশ্ব-মানবতার কল্যাণ করা।
একজন শিক্ষিত ব্যক্তির দায়িত্ব অনেক বিশাল। কারণ তারাই প্রত্যক্ষভাবে দেশ পরিচালনা করেন। তাদের সৎ-নীতিমান ও দেশপ্রেমিক হয়ে নিরক্ষর এবং স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদেরই অনুসরণ করে। এ কারণে শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এককথায় বলা যায়, নৈতিকতাবোধ না থাকলে সেই শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
একটা দেশের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী এবং স্বাধীনতা অর্জনের চেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষা যে কতটা প্রয়োজনীয়, ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পেশার শিক্ষিত শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহারসহ সবরকম অপরাধমূলক কাজের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শিক্ষাঙ্গন-রাজনীতি-প্রশাসন-ব্যবসা-বাণিজ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া প্রতিটা ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির সূচনা করেছেন শিক্ষিত ব্যক্তিরাই, যা এখনো চলছে। অধিকাংশের মধ্যে শুধু যে কোনো উপায়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া নীতি-আদর্শ-সততা বা দেশপ্রেম বলে কিছু নাই। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জন ও চর্চার সর্বোচ্চ স্থান। কিন্তু নীতিহীন শিক্ষক ও অন্যান্য ব্যক্তির কারণেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার পরিবর্তে পরিণত হয়েছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও মাদকের অভয়ারণ্যে। গতমাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সহিংসতা কারণে অনেক হতাহতের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে আর এসব ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছেন কিছু শিক্ষক, যাদের দায়িত্ব জাতি গঠন করা। দৈনিক ইত্তেফাকও এ প্রসঙ্গে শিরেনাম করেছে, ‘সংঘাতের নেপথ্যে কিছু শিক্ষকের স্বার্থ’।
শিক্ষার্থীরা জীবনের সবক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই অনুসরণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এধরনের শিক্ষকের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দেখে তাদেরও অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনার পরিবর্তে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক, চাঁদাবাজি ও নারী নির্যাতনে হাতেখড়ি হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রে। বিদ্যুত্-ওয়াসা-গ্যাস-রেল-বিমান-বিআরটিসি-কাস্টমস-বিআরটিএ-লাভজনক এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান লোকসানি এবং জনগণ হয়রানির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে শুধু দুর্নীতিবাজ এবং আইন-ভঙ্গকারী ব্যক্তিদের কারণে। নাটক সরণির আগুন লাগা ভবনের অনিয়ম দেখার দায়িত্ব ছিল রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থার শিক্ষিত কর্মকর্তাদের। কিন্তু তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই ভবনে আগুন লেগে প্রায় অর্ধশত মানুষকে প্রাণ হারাতে হলো। দেশে এবং লন্ডনে পড়াশোনা করা শিক্ষিত আইনজীবীদের অনেকে সর্বোচ্চ আদালতে যে সংঘর্ষ ঘটালেন, সেটা থেকে জনগণও আইন অমান্য করার শিক্ষা পেল।
একটা জাতিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন সেই জাতির শিক্ষিত শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবীরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন একটা উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে, এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকারচক্র পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। কিন্তু এখন স্বাধীন দেশের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ নিজেরাই তাদের ক্ষতিকর কাজের মাধ্যমে দেশ ও জাতি ধ্বংসে ভূমিকা রাখছেন।
তারা যদি না বুঝে এসব করতেন, তাহলে তাদের এসব থেকে বিরত থাকতে বলা যেত। কিন্তু সবাই জেনে-বুঝেই এধরনের ক্ষতিকর কার্যকলাপ করছেন। তাদের বোধোদয় না হওয়া পর্যন্ত উন্নত সভ্য এবং আইনের শাসনে পরিচালিত দেশ গঠন সম্ভব হবে না।