শিক্ষকের প্রতি অবহেলার অবসান কবে?
গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক।।
শিক্ষক একটি আদর্শের নাম। শিক্ষকের নির্দেশনা একজন শিক্ষার্থীকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারে সহযোগিতা করে। শিক্ষকতা পেশা বিভিন্ন রকম হতে পারে।
প্রথমত সরকারি প্রাইমারি ও কিন্ডার গার্টেন, কোচিং ভিত্তিক শিক্ষকতা, মাধ্যমিক পর্যায় (সরকারি ও বেসরকারি), কলেজ পর্যায় (সরকারি ও বেসরকারি) এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়।
উন্নত বিশ্বের তূলনায় বাংলাদেশের শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ব্যতিক্রম। উন্নত দেশে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের ব্যবস্থার কথা তেমন শোনা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইভেট বা কোচিংয়ের প্রবণতা অনেক বেশি।
আর্থিক সুবিধার দিকে যদি তাকাই তাহলে অন্যান্য পেশা থেকে শিক্ষকতা পেশায় সুবিধা অনেক কম। বিধায়, প্রাইভেট বা কোচিং সেন্টার ভিত্তিক লেখাপড়া আমাদের দেশে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে, যার মূল উৎপাটন করা আদৌ সম্ভব কিনা সন্দেহের ব্যাপার।
শিক্ষিত যুবক যুবতীরা বড় অসহায়। তারা না পারে কৃষি কাজ করতে, না পারে রিক্সা-ভ্যান চালাতে, না পারে যেনতেনো কোন ব্যবসা করতে, না পারে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে। আর্থিক সুবিধা মর্যাদাপূর্ণ না হওয়ায় মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় বিমূখ।
অধিকাংশ মেধাবীরা চায় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে অথবা সরকারি কোন চাকরির পিছনে ছুটে বেড়ায়। এখানেও যারা ভাগ্যের বিড়ম্বনায় ভালো কোন চাকরি পায় না তখন বাধ্য হয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন।
সরকারি বা বেসরকারিভাবে যদি এসব শিক্ষিতদের মূল্যায়ন করে চাকুরীর ব্যবস্থা করা হতো এবং আর্থিকভাবে তাদের সচ্ছল করা যেত তাহলে শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীরা অধিক আগ্রহ পেত। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় আজ এক আওয়াজে পরিণত হয়েছে যে, লেখাপড়া শিখে কি হবে ?
ভালো লেখাপড়া না শিখেও শিক্ষিত ও মেধাবীদের চেয়েও আরো অনেক বেশি উপার্জন করা যায় এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। পুঁজিবাদী সমাজ সংস্কৃতিতে অর্থভিত্তিক সম্মান ও সমাজ ব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষিত মানুষ ও শিক্ষকেরা। পকেটে পয়সা কম থাকায় সমাজ তাঁদের তেমন মূল্য দিতে চায় না।
উন্নত রাষ্ট্রে শিক্ষক এবং শিক্ষকতা পেশার মূল্যায়ন, আর্থিক সুবিধা বেশি থাকায় সেখানকার সমাজব্যবস্থায় তাঁরা অনেক সম্মানিত। বিধায়, এই পেশায় তাঁরা আগ্রহী হন। আবার ঐদেশগুলো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জগতে অগ্রসরমান। আমাদের রাষ্ট্র তার ঠিক বিপরীত। শিক্ষিত ও শিক্ষকদের দেখলে সমাজ তাঁদের তেমন মূল্যায়নই করতে চায় না।
এদেশে মেধাবী, নতুন আবিষ্কারকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বিদেশে উচ্চ মূল্যে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের দেশ কালচারাল ল্যাগ বা সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতায় নিপতিত হচ্ছে । কী পাপ করেছে এসব শিক্ষিতরা?
শিক্ষকেরাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য অকাতরে জ্ঞান দান করে চলেছে। একমাত্র শিক্ষকেরাই অন্যের সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ করে শিক্ষার্থীদের অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করন। তাঁরা চান শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে বিশ্বের দরবারে উঁচিয়ে ধরতে। কিন্তু বিধি বাম !!
বারবার পিছলে পড়ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমরা পর্যালোচনার মাধ্যমে উদঘাটনের চেষ্টা করব শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে কি কি সুবিধা-অসুবিধা বিরাজমান, আর কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিলে শিক্ষা কার্যক্রম সমৃদ্ধ হতে পারে। চাহিদা মোতাবেক শিক্ষক না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থায় স্থবিরতা নেমে আসছে।
## শিক্ষকদের গবেষণার কাজে নিয়োজিত না করে নানামুখী কার্যক্রমে ডুবিয়ে রাখা।
## যথাযথ ক্লাস ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে।
## সরকারি এবং এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি-না সে তদারকিতে যথেষ্ট গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়।
## নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে অধিক পরিমাণে শিক্ষক সংগঠন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তাদের মধ্যে কোন একতা নেই। দাবি আদায়ে তাঁরা এক কাতারে দাঁড়াতে পারে না। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষক সমাজ। অথচ একক শিক্ষক সংগঠন হলে এটাই হতে পারে দাবি আদায়ের সবচেয়ে বড় সংগঠন।
## শিক্ষকরাই শিক্ষকের শত্রু। একজন শিক্ষক আর একজন শিক্ষককে সুনজরে দেখেন না। বিধায়, সাধারণ মানুষ ও প্রশাসন এই সুযোগ নিয়ে শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করে।
## স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ ও অর্থলোভী ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্ম শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত বিপাকে ফেলে।
## পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শাসনে প্রশাসনিক এবং অভিভাবকদের বাঁধা শিক্ষকদের অসম্মানিত করে। এজন্য মন উজাড় করে শিক্ষক সমাজ নিজের দক্ষতা উদ্ভাসিত করে পাঠদান করতে ব্যর্থ হন। এর ফলে তাঁদের মনোবল ভেঙে পড়ে। বিধায়, শিক্ষক নিজের মানসম্মান রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন।
## শিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা অফিসসহ হাঁটে-মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণে তাদের মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়।
## নিয়োগ প্রাপ্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের এমপিও ভূক্তিতে চরমভাবে হয়রানিতে ফেলে তাদেরকে আর্থিক সুবিধা বঞ্চিত করার ফলে তাঁরা পাঠদানে আগ্রহ হারাচ্ছে।
## দুর্মূল্যের বাজারে শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি এবং তিনটি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা প্রদান করা জরুরি।
## সদ্য সরকারিকৃত তিন শতাধিক স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের সরকারিকরণের নামে চরম আমলাতান্ত্রিক হয়রানিতে ফেলে তাদেরকে সুবিধাবঞ্চিত করার চেষ্টা সরকারের অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। প্রায় সকল স্কুল ও কলেজে প্রচুর সংখ্যক শিক্ষক অবসরে যাওয়ায় এসব বিষয়ে শিক্ষক শূণ্যতা দেখা দিয়েছে। এজন্য শিক্ষার্থী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া অস্থায়ীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতেও অধ্যক্ষ মহোদয়েরা প্রশাসনিক হয়রানির অভিযোগ করেন। শিক্ষা বান্ধব সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারিকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এডহক নিয়োগ সম্পন্ন ও শূণ্য পদসমূহের ঘাটতি পূরণ না করলে শিক্ষা খাতের ধ্বস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।
## মেধাবী কর্মঠ ও অনুগত শিক্ষকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে চাটুকার, তেলবাজ ও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের বেশি মাত্রায় মূল্যায়নে দক্ষ শিক্ষক দক্ষতা বিমূখ হয়ে পড়েছে।
## সামান্য ভুলে শিক্ষকদেরকে প্রশাসনিক ও অভিভাবক মহলের পক্ষ থেকে গালিগালাজ, ধিক্কার ও অবমূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা বেশি মাত্রায় প্রশ্রয় পেয়ে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারছে না। ফলে, তারা ভুলের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। যা শিক্ষককে করছে হতাশ আর শিক্ষার্থীরা তাদের ভুল শুধরে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর জাতি প্রকৃত শিক্ষা না পেয়ে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
## কিছু কিছু শিক্ষকের নৈতিক অবক্ষয় ও দুশ্চরিত্রের কারণে সম্পূর্ণ শিক্ষক সমাজের উপর তার প্রভাব পড়ছে। এজন্য ঐসব শিক্ষকদের পাশাপাশি ত্যাগী শিক্ষকগণও সমাজে নিন্দিত হয়ে মনোবল ভেঙে পড়ে পেশায় উদ্যমতা হারিয়ে ফেলছে।
## সেন্টার পরীক্ষায় শিক্ষকদের হাতে কোন নাম্বারিং করার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্লাসে অনুপস্থিতি শিক্ষকদের প্রকৃত শিক্ষাদানে বাঁধার সৃষ্টি করছে।
## শিক্ষিত যুবক যুবতীদের যথাযথ কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় ধীরে ধীরে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
## প্রকৃত সৃজনশীলতার পরিবেশ তৈরি ও তা বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। না হলে তাঁরা পেটের চিন্তা করবেন, না কি সৃষ্টিশীলতা উপহার দেবেন।
## মাত্রাতিরিক্ত বইয়ের বোঝা কমিয়ে কর্মমুখী শিক্ষার সঠিক বিস্তরণ ঘটাতে হবে।
শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি অবহেলা দেশ ও জাতির স্বার্থ পরিপন্থী। শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষক সমাজ উজ্জীবিত হলে সুশিক্ষা বিস্তরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। সর্বোপরি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার যথাযথ মূল্যায়ন, শিক্ষকদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন; দেশ ও জাতির স্বার্থ পুনরুদ্ধারে একাট্টা হয়ে কাজ করতে সহযোগিতা করবে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বিধায়, শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয়ের নিকট আমার এ সুপারিশমালা বাস্তবায়নের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করতেই পারি।
লেখক-
প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, ফুলতলা, খুলনা ।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়