শিক্ষাবার্তা'য় সংবাদ প্রকাশ: হিসাব শাখা থেকে 'আউট' হিসাব সহকারী রাসেল
আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ কুষ্টিয়ার খোকসা সরকারি কলেজ ফান্ড থেকে মাত্র চার মাসে গুটিকয়েক শিক্ষকের যোগসাজসে ২৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা কলেজটির অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেলকে অবশেষে হিসাবের দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহত দিয়েছে কলেজ প্রশাসন। শিক্ষাবার্তা'য় সংবাদ প্রকাশ এবং কলেজটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে কলেজটির একাডেমিক কাউন্সিলের কয়কেজন সদস্য।
অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী মোঃ নাজমুল হুদা রাসেল কর্তৃক অর্থ আত্বসাতের বিষয়ে গত ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ইং তারিখে "সাবেক অধ্যক্ষের যোগসাজশে ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ অফিস সহকারীর" শিরোনামে, গত ১২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে "এখনও বহাল তবিয়তে খোকসা সরকারি কলেজের সেই অফিস সহকারি" শিরোনামে ও ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে "খোকসা সরকারি কলেজ: সেই রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ, সঙ্গী যারা!" শিরোনামে এবং সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে "খোকসা: বৈধতা পেল ১২ কর্মচারীর নিয়োগ, নিয়োগ বাণিজ্যের হোতারা অধরা!" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জানা গেছে, গত বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) কলেজটির একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী নাজমুল হুদা রাসেলকে হিসাবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি কাউন্সিলে উপস্থিত সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সোমবার (০১ জানুয়ারী ২০২৪) হিসাব সহকারীর দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতির বিষয়ে একটি অফিস আদেশ দেওয়া হয়। অফিস আদেশে অফিসের হিসাব শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় অফিস (সাধারণ) শাখায় দায়িত্ব পালনকারী অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মোঃ শরিফুল ইসলামকে।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল হুদা রাসেলের সাথে আর্থিক অপকর্মের সঙ্গী হিসেবে (শিক্ষাবার্তা'র অনুসন্ধানে এবং অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে) যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনুসন্ধানী সংবাদ এবং নিরীক্ষা কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়মে নাজমুল হুদা রাসেল বাদে অন্যান্য যাদের নাম উঠে আসে তারা হলেন, কলেজটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (অবসর প্রাপ্ত) মুহঃ আনিছ-উজ-জামান, সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যাপক মোঃ বেলাল উদ্দিন ও কলেজটির সাবেক অর্থ কমিটির সদস্য ও অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিসুর রহমান। শিক্ষাবার্তা'য় সংবাদ প্রকাশ এবং নিরীক্ষা কমিটির নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি একাধিকবার উঠে আসলে অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিসুর রহমানকে অর্থ কমিটির সদস্য পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। তৎকালীন অর্থ কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে একই একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তক্রমে বুধবার (২৭ ডিসেম্বর ২০২৩) যে উন্নয়ন কমিটি (যেটা আগে অর্থ কমিটি নামে প্রচলিত ছিল) গঠন করা হয় সেখানে আনিসুর রহমানকে রাখা হয়নি। এই কমিটির সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রাজ্জাককে আহ্বায়ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবু আখতার সিদ্দিককে সদস্য এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রভাষক নারায়ন চন্দ্র ব্রজবাসীকে সদস্য করা হয়েছে।
অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী নাজমুল হুদা রাসেল এবং অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আনিসুর রহমানকে ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ দেওয়া হলেও সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সহকারী অধ্যাপক মোঃ বেলাল উদ্দিন এসবের উর্ধ্বে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতি সম্প্রতি কলেজটির ১০ জন কর্মচারীর (এডহক নিয়োগ পাওয়া) নিকট থেকে জনপ্রতি ১২ হাজার করে টাকা নেন হিসাব সহকারী নাজমুল হুদা রাসেল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত এসব কর্মচারীদের চাকরী স্থায়ী করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি এই অর্থ তাদের থেকে নেন। তবে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এই অর্থ তিনি ফেরত দিতে বাধ্য হন।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিজীবী তার যোগদানের তারিখ হতে প্রতি তিন বছর পর পর ১৫ দিনের ছুটিসহ এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন যাকে শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ও ভাতা বলে। সম্প্রতি এই শ্রান্তি বিনোদনের অর্থ প্রাপ্য হন খোকসা সরকারি কলেজের শিক্ষক কর্মচারীরা। আর এই অর্থ উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিস থেকে নিতে হলে ঘুষ দিতে হবে জানিয়ে ভাতা প্রাপ্য সকল শিক্ষক কর্মচারীর নিকট থেকে জন প্রতি ৪০০ টাকা করে আদায় করেন নাজমুল হুদা রাসেল যার সিংহভাগই তিনি নিজে ভোগ করেন। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে খাত, খাত বহির্ভূত এমন কোন জায়গা নেই যেখান থেকে রাসেল টাকা নেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, গত এক যুগে এর আগে কলেজের যেই অধ্যক্ষের দায়িত্বে আসুক না কেন অধ্যক্ষের চেয়ার চলেছে মূলত নাজমূল হুদা রাসেলের ইশারায়। কোন শিক্ষক কোন যৌক্তিক কারণে এক মিনিট দেড়িতে কলেজে আসলে তলব করতেন রাসেল। শিক্ষকদের ছুটি লাগলে ছুটি নিতে হতো রাসেলের কাছ থেকে। স্থানীয় হওয়ায় এবং কলেজের সন্নিকটে বাড়ি থাকায় তার প্রভাব ছিল সর্বত্র। কেউ কোন প্রতিবাদ করলে তিনি তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্চিত করতেন।রাসেল কর্তৃক লাঞ্চনার হাত থেকে রেহায় পাননি জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরাও। তবে হিসাবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় অনেকটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
জানা গেছে, ২০ অক্টোবর ২০২২ ইং তারিখ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ইং তারিখ পর্যন্ত চার মাসের অডিট করা হয় কলেজটির অভ্যন্তরীণভাবে গঠিত অডিট কমিটি কর্তৃক। মাত্র এই চার মাসে ২৬ লাখ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে অডিট প্রতিবেদনে। গত ২৫ আগস্ট খোকসা ডিগ্রি কলেজ সরকারীকরণ করা হয় ০৮ আগষ্ট ২০১৮ সালে। জাতীয়করণের পর দীর্ঘ পাঁচ বছর পর খোকসা সরকারি কলেজ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যক্ষ পায় গত ১৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে। ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ইং তারিখে শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহা. আব্দুল লতিফ যোগদান করেন। যোগদানের পরেই তিনি এই অডিট রিপোর্টটি হাতে পান। কলেজটির অর্থ হরিলুট হয়েছে বুঝতে পেরে তিনি জাতীয়করণ ঘোষণার দিন থেকে তাঁর যোগদানের আগের দিন পর্যন্ত পুরো সময়কালের আর্থিক অডিট করার চিন্তা করেন। তবে যোগদান করেই তিনি দেড় মাসের প্রশিক্ষণে চলে যান। প্রশিক্ষণ শেষে কলেজে ফিরেই তিনি গত বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) ২০২৩ ইং তারিখে কলেজটির একাডেমিক কাউন্সিলের জরুরি সভায় পাঁচ সদস্যের নতুন একটি অডিট কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে সহকারী অধ্যাপক মোঃ সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে এবং প্রভাষক চন্দন কুমার বিশ্বাস, প্রভাষক মোঃ আমজাদ আলী, প্রভাষক সামছুল আলম ও প্রভাষক মুহাঃ আরিফ হোসেনকে সদস্য করা হয়। যদিও এই পাঁচ সদস্য নিরীক্ষা কমিটির মধ্যে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রভাষক মুহাঃ আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে কলেজে দৈনিক মুজুরি ভিত্তিক ১২ জন কর্মচারী নিয়োগে নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, হিসাবের দায়িত্ব থেকে রাসেলকে অব্যাহতি প্রদান এবং অর্থ কমিটি থেকে আনিসুর রহমানকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে বোঝা যায়। চার মাসের অডিটে ২৬ লাখ টাকার অডিট আপত্তি উঠলে পাঁচ বছরের অডিটে অন্তত ৫/৬ কোটি টাকার উপরে অডিট আপত্তি উঠবে বলে সহজেই ধারণা করা যায়। তিন সদস্যের অডিট কমিটির মাধ্যমে করা অডিটের মত যদি সঠিক অডিট করা হয় তাহলে নাজমুল হুদা রাসেলসহ উল্লেখিত শিক্ষক বাদেও দুই তিন জন শিক্ষকসহ তিন চার জনের নাম উঠে আসতে পারে বলে জানান এই শিক্ষকরা।
কলেজটি একটি পরিপূর্ণ সরকারি কলেজের মত আনার চেষ্টা করছি জানিয়ে কলেজটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল লতিফ জানান, এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজ থেকে জাতীয়করণ হলেও পরিপূর্ণ সরকারি কলেজের নিয়মকানুনের মধ্যে আসতে একটু সময় লাগবে। এজন্য সকলে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট খবরঃ
- ১. খোকসা সরকারি কলেজ: দুর্নীতিকে না বলছেন দুর্নীতি করা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বেলাল
- ২. খোকসা সরকারি কলেজ: সাবেক অধ্যক্ষের যোগসাজশে ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ অফিস সহকারীর
- ৩. এখনও বহাল তবিয়তে খোকসা সরকারি কলেজের সেই অফিস সহকারি
- ৪. খোকসা সরকারি কলেজ: সেই রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ, সঙ্গী যারা!
- ৫. খোকসা: বৈধতা পেল ১২ কর্মচারীর নিয়োগ, নিয়োগ বাণিজ্যের হোতারা অধরা
- ৬. খোকসা সরকারি কলেজ: প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য
- ৭. খোকসা সরকারি কলেজের নতুন অধ্যক্ষ ড. লতিফ
- ৮. খোকসা সরকারি কলেজে নবাগত অধ্যক্ষের যোগদান
- ৯. বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষার বিকল্প নাই: অধ্যক্ষ লতিফ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০১/২০২৪
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়