মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ আদৌ হবে?
মারুফ হাসান ভূঞা।।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবন যেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনের মতো হয়ে গেছে। দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের যেমন বেতন বাড়ানো, সময় মতো বেতন পাওয়ার, সময়মতো ইদ বোনাস, ভাতা পাওয়ার আন্দোলন করতে হয়। ঠিক সে সমান সংগ্রাম করছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত হলেও জাতীয় করন হয়নি। এই শিক্ষকদের আহাজারি শোনবার কেউই নেয়।
মানুষ গড়বার মতো বিশাল কারুকার্য করেন, শিক্ষার্থীদের মনন, চিন্তা, ভাবনাকে ভাবে গবেষণা ও পরিচর্যা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন এই শিক্ষকরা। কিন্তু সেই শিক্ষকরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মতো শোষিত হচ্ছে । শিক্ষকরা হচ্ছেন শিক্ষা উৎপাদনের মূল স্রষ্টা, শিক্ষকরা মন প্রাণ দিয়ে শিক্ষাগত পেশাকে উপাসনা হিসেবে নেন। সেই শিক্ষকরা রাষ্ট্র থেকে সামান্য প্রাপ্য সম্মানটুকুও পেতে পারে না?
যুগে যুগে শিক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা আজ স্বপ্নের পৃথিবীতে বাস করছে। আর সেই শিক্ষার সংগ্রাম কে যারা প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে, মানুষের মাঝে গড়ে তুলেছে এবং এখনো যারা শিক্ষাকে মানুষের মাঝে ছড়াচ্ছে, গড়ে তুলেছে সেই মহান শিক্ষকরা দেশে আজ বড় অসহায়।
এমন নির্বিকার অবস্থা বেতন স্বল্পতায় শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য করতে হয় , অনেক শিক্ষককে অসৎ হতে হচ্ছে । মাধ্যমিকের বেশিরভাগ শিক্ষকের সাথে কথা বললেই উপার্জনের এসব দৃষ্টিগোচর পথ সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। শিক্ষকদের কেন উপার্জনের দৃষ্টিগোচর পথ অবলম্বন করতে দেখতে হয়? শিক্ষকদের কেনো অসৎ পথে উপার্জন করতে হয়?
তাহলে বুঝতে হবে এসব বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জীবন কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, শিক্ষক হিসেবে পারিবারিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ করা। স্বল্প বেতনে যা কল্পনা করাই অসম্ভব বর্তমান বাস্তবতায়।
যে শিক্ষকরা সারা জীবনের সম্পূর্ণ মেধা, শ্রম নিবেদন করে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ ও মানুষ্যত্বকে সৃষ্টি করে। আবার সেই শিক্ষকদেরেই শিক্ষকদেরেই অসৎ পথ, অসৎ উপায়, দৃষ্টিগোচর পদ্ধতি অনুসন্ধান করতে হচ্ছে। বেতন স্বল্পতা, প্রাপ্য মর্যাদা না পাওয়ার বঞ্চনা থেকে শিক্ষকরা এমন চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
উপায় না পেয়ে যখন আন্দোলন, সংগ্রাম করেছে তখন শিক্ষকদের পেটানো হলো, আশ্বস্ত করা হলো, সমঝোতা করা হলো। কিন্তু সমাধান কিংবা সম্মান কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষকদের বেতন বাতা , ইদ বোনাস সময়মতো না পাওয়ার আহাজারি এখনো শুনতে হয়, শোনা যায়।
বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের দাবিতে শিক্ষকরা আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন। সরকার সে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেছিলো কিন্তু আশ্বাসের কোনো আস্থা শিক্ষকরা পাচ্ছে না। শিক্ষকরা রীতিমতো কাতরাচ্ছে। বেসরকারি এসব মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও ভুক্ত হওয়ায় সরকার থেকে সামান্য ভাতা পেয়ে থাকেন যা খুবই নগণ্য।
অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ সমূহে শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। পাশের দেশ ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন ৩৩,৪০০ টাকা। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল কিংবা ভূটান এসব দেশে শিক্ষায় বরাদ্দ থাকে জিডিপির অন্তত প্রায় ৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ হয়। যা দিয়ে পরিকল্পিত শিক্ষার আয়োজন, কিংবা শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা দুষ্কর।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে যদি কোনো শিক্ষক মানসিক ভাবে চিন্তা মুক্ত না হতে পারে, বা শিক্ষকদের চিন্তার উপর কোনো চাপ পড়ে সেটি সরাসরি তাঁর পাঠদানে ও প্রভাব পড়ে। এটি শুধু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নয়, সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। শিক্ষকদেরও পারিবারিক, সামাজিক জীবন রয়েছে, সে ক্ষেত্রে একজন শিক্ষক হিসেবে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা বেশি। কিন্তু শিক্ষকদের সে সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হয়।
সুতরাং সরকারকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও জাতীয়করণ নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। মানসম্পন্ন বেতন ভাতা নির্ধারণ করে সময়মতো সে বেতন, ভাতা শিক্ষকদের হাতে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দিয়ে বেসরকারি এসব মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের উদ্যোগ নিন।
লেখক-
কলামিস্ট ও লেখক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/১৪/০৩/২০২৪