পরীক্ষার সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীবান্ধব হোক
করোনাভাইরাস মহামারীতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নজিরবিহীন এক বিপর্যয়ে পড়েছে। মার্চ মাস থেকেই কার্যত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতি বন্ধ। কিন্তু স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে পাঠদান ও পরীক্ষার কিছু কিছু কার্যক্রম চলমান। প্রাইভেট বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন পাঠদান ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে অনেকখানি সফল হলেও দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে।
বিগত মাসগুলোতে এসব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চললেও এই সংকটের সুরাহা হয়নি। আর এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া। এই পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের শারীরিক উপস্থিতিতে কাগজে-কলমে নিতে হবে। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি আবাসিক হল বন্ধ রেখে এসব চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থী অভিভাবকরা বলছেন, আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন।
রবিবার ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ভার্চুয়াল সভায় পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরে ইউজিসি। এসব সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা চলছে আবাসিক হল বন্ধ রেখে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে।
বেশিরভাগ উপাচার্য ইউজিসির সঙ্গে সহমত জানিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতির কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। কিন্তু হল বন্ধ রেখে পরীক্ষার বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের একাংশের ভাষ্য, হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেওয়া মানে শিক্ষার্থীদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া। শুধু পরীক্ষার্থীদের হলে থাকার সুযোগ চান তারা। তবে অন্য অংশের যুক্তি, করোনায় চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ নেই, বয়স চলে যাচ্ছে। এ জন্য যেকোনো মূল্যে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ করতে চান তারা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের অনেকেই উদ্বিগ্ন পরীক্ষার মান নিয়ে।
তারা মনে করছেন যথাযথভাবে পাঠদান শেষ না করে তড়িঘড়ি করে পরীক্ষা নেওয়া হলে সেটা মানহীন হয়ে পড়তে পারে। এছাড়া আরেকটি সংকট হলো বিজ্ঞান ও নানা প্রায়োগিক বিষয়গুলোর গবেষণাগার সুবিধা ও শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া কোর্স সমাপ্ত করাই সম্ভব না হওয়া। ফলে এখনই এমন বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়া জটিল হবে।
অবশ্য ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেছেন, পরীক্ষা গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিনস কমিটি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলসহ সংশ্লিষ্ট কমিটিই নেবে। তবে পরীক্ষার মান নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ইউজিসি বলছে করোনাকালে সরকারি নির্দেশনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বন্ধ রাখতে হবে।
আর শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাস পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিতে হবে। এ জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাস শুরুর এক ঘণ্টা আগে ক্যাম্পাসে প্রবেশ এবং শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হবে।
কিন্তু আবসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষার নেওয়ার এই সুপারিশটি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। তারা বলছেন হল বন্ধ রাখলে পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীরা কোথায় থাকবে, তাদের নিরাপত্তা দেবে কে? সাময়িক সময়ের জন্য মেস বা ভাড়াবাড়িতে ওঠার আর্থিক সামর্থ্য অনেক শিক্ষার্থীরই নেই। এছাড়া এতে বরং স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। পরীক্ষা নিতেই হলে কর্তৃপক্ষের উচিত শুধু পরীক্ষার্থীদের হলে থাকার ব্যবস্থা করা। সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় বলা যায়, শুধু পরীক্ষার্থীদের জন্য হলেও আবাসিক হল খুলেই পরীক্ষা নেওয়াটা যৌক্তিক হবে।
ইউজিসির সভায় উপাচার্যরা জানিয়েছেন, অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত থাকলেও পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা হতাশ। ফলে পরীক্ষা বা মূল্যায়নের ব্যবস্থা না থাকলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে। এখন তাই জাতীয় স্বার্থেই পরীক্ষা নেওয়া দরকার। অন্যদিকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের চূড়ান্ত পরীক্ষা না হওয়ায় যে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারছেন না তাদের বিষয়টিও বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
এজন্য সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষার প্রজ্ঞাপনে আবেদনের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য ইউজিসিকে পিএসসি বরাবর চিঠি দিতে অনুরোধ করেছেন উপাচার্যরা। অনেক শিক্ষার্থীই প্রশ্ন তুলছেন, করোনাকালে তো নিয়োগ পরীক্ষা থেমে নেই। দেশে সবকিছুই চলছে। তাহলে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবেন কেন? এমতাবস্থায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়াই যৌক্তিক হবে। তবে এই প্রক্রিয়া যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হয় সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।