তীব্র শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে সুনামগঞ্জের প্রাথমিক শিক্ষা
সুনামগঞ্জঃ প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঁচ থেকে ছয়জন শিক্ষক থাকেন। বিদ্যালয়গুলোর পাঠদান চলে দুই শিফটে। কিন্তু অবিশ^াস্য হলেও সত্য, মাত্র একজন শিক্ষক দিয়েই চলছে তাহিরপুর উপজেলার শরীফপুর রাধাচরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত চার বছর ধরে এভাবেই চলছে এই বিদ্যালয়টি।
অব্যাহত শিক্ষক সংকটের কারণে ওই বিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়ার মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। একা সব শ্রেণির পাঠদান করেন সহকারী শিক্ষক উৎপল কুমার তালুকদার। অবশ্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আবদুর রহমান বলেছেন, ‘সারা জেলায়ই শিক্ষক সংকট রয়েছে। তাহিরপুরের ওই বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে দ্রুত শিক্ষক দেওয়া হবে।’
শুধু তাহিরপুর নয়, গোটা সুনামগঞ্জ জেলাতেই শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে প্রাথমিক শিক্ষা। জেলায় সহকারী শিক্ষকের ৪৯৩টি পদ শূন্য রয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৩৪টি। এর মধ্যে শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের শরীফপুর রাধাচরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯০ সালে। এই বিদ্যালয়ের মোট ছাত্র-ছাত্রী ৬২ জন। বিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষকের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র একজন সহকারী শিক্ষক। ২০২০ সাল থেকে তিনি একাই পাঠদান করছেন। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত পাশের দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও প্রায় একই অবস্থা। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৪১ জন।
৫ জন শিক্ষকের স্থলে দীর্ঘ ৬ মাস পাঠদান হয়েছে একজন শিক্ষক দিয়ে। একজন শিক্ষিকা মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে সম্প্রতি যোগদান করেছেন। ১২ বছর প্রধান শিক্ষক নেই দুর্লভপুরে।
শরীফপুর রাধাচরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র লোকমান হোসেন ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র মোবারক হোসেন জানান, অন্যান্য সব স্কুলের ৪/৫ জন স্যার-ম্যাডাম থাকেন। আমাদের স্কুলের মাত্র একজন স্যার। সবসময় একজন স্যারই আমাদের সবাইকে পড়ান।
দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সাথী রানী তালুকদার বলেন, ‘আমাদের স্কুলে পাঁচজন শিক্ষকের পদ রয়েছে। ছয় মাস আমি একা সবকিছু করেছি। প্রধান শিক্ষক নেই ১২ বছর ধরে। শিক্ষক সংকট থাকায় আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।’
দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অভিভাবক মো. আজাদ মিয়া বলেন, আমাদের স্কুলটি ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক শাহেদ আলী। কিন্তু এখন শিক্ষকের অভাবে সঠিকভাবে লেখাপড়া হচ্ছে না। নানা জায়গায় আবেদন করেও শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। একজন শিক্ষক ৬/৭ মাস এক একা কোনোভাবে স্কুল চালিয়েছেন।’
শরীফপুর রাধাচরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিদাতা বিজয় তালুকদার বলেন, ‘আমার বাবা খুব আশা করে গ্রামের উন্নতির জন্য নিজের জমিতে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু মাস্টার না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া হয় না। একজন মাস্টার কী করে স্কুল চালায়?’
ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উৎপল কুমার তালুকদার বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে আমি একাই পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো কারণে আমি অসুস্থ হলে স্কুল বন্ধ থাকে। গত বছর আমি বিপিএডে গিয়েছিলাম, স্কুল শিক্ষকশূন্য ছিল। তখন দুইজন শিক্ষক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি স্কুলে আসার পরদিনই তারা চলে যান। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করে আসছি। কিন্তু শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই একাই তিন শ্রেণির ছাত্রকে একসঙ্গে পাঠদান করতে হচ্ছে।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আবদুর রহমান বললেন, ‘হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ জেলায় ৪৯৩ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। এর মধ্যে তাহিরপুর উপজেলায় ৫৫টি শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। যার কারণে শিক্ষক স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সহকারী শিক্ষক পদায়নে পাশের এলাকায় নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় সব বিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারিনি। যেখানে শিক্ষক স্বল্পতা দেখা দিয়েছে বা একজন শিক্ষক রয়েছেন সে বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে দ্রুত শিক্ষক দেওয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী শিক্ষক নিয়োগের কার্যক্রম দ্রুত চলছে। সে নিয়োগটি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষক স্বল্পতা দূর হবে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/০৫/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তা’য়