টানা ৬ বছর ক্লাস নেন প্রক্সি শিক্ষক বেতন নেন সহকারী অধ্যাপক সামসুল আলম
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ দুই বছর একটা ক্লাসও নেননি, টানা চার বছর মাঝে মাঝে কলেজে এসেছেন মন চাইলে দুই একটা ক্লাস করিয়েছেন। ক্লাস নিয়েছেন প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে। ক্লাস না করলেও বেতন-ভাতা প্রতি মাসে ঠিকই উত্তোলন করেছেন। আবার বেতন নিয়েছেন প্রক্সি শিক্ষকও। বলছিলাম রাজধানীর সায়েদাবাদের আর কে চৌধুরী কলেজের রসায়ন বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলমের কথা। প্রভাবশালী একজন এমপির বন্ধু পরিচয় দিয়ে তিনি কলেজে দাপট দেখিয়ে এই অপকর্ম গুলো করেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) একটি তদন্ত প্রতিবেদনে প্রক্সি ক্লাস করিয়ে বেতন ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি উঠে আসে।
জানা গেছে, সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলম পেশায় একজন শিক্ষক পরিচয়ধারী হলেও তার প্রধান পেশা ঠিকাদারি। অধিকাংশ সময়ই তিনি ঠিকাদার পেশায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কলেজে নিয়মিত তো আসেন-ই নাই এমনকি কোন জাতীয় দিবসেও উপস্থিত থাকেননি। তৎকালীন কলেজ অধ্যক্ষ তাকে একাধিকবার শোকজ নোটিশ দিয়েছেন। তবে কলেজটির তৎকালীন উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলাম তৎকালীন গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি রসায়ন বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মোঃ সামসুল আলমের বন্ধু হওয়ায় অনুপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে অধ্যক্ষের সাথে মিমাংশা হওয়ায় ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কলেজটি একটি ক্লাস না নিয়েও পার পেয়ে যান। কভিডকালীন সময়েও অনলাইনে তিনি একটি ক্লাস করাননি। কলেজটির তৎকালীন উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলাম রয়াসন বিষয়ের ক্লাস প্রক্সি শিক্ষক মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ জুম অ্যাপে নিবেন বলে জরুরি নোটিশ জারি করে যার কপি শিক্ষাবার্তা'র হাতে রয়েছে।
কলেজটির একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ০৪ জন। এই বিভাগে ৪ জন সহকারী অধ্যাপক (পদার্থ, গণিত, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান) রয়েছেন-যাদের প্রত্যেকে প্রতিমাসে এমপিওরর সরকারি অংশ ৪৩,১৩৫/- টাকা এবং কলেজ বাড়িভাড়া বাবদ ১৫,০০০/- টাকা গ্রহণ করেন। বন্ধুত্বের পুরষ্কার হিসেবে উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলাম রসায়ন বিভাগের শিক্ষক সামসুল আলমের ক্লাস গ্রহণের জন্য ওয়ালিউল্লাহ প্রক্সি শিক্ষক নিয়োগ দেন। ওয়ালিউল্লাহ ইতোমধ্যে প্রক্সি ক্লাস বাবদ ৫/৬ বছরে ৪-৫ লক্ষ টাকা নিয়ে গেছেন। মাত্র চারজন ছাত্র পড়িয়ে প্রায় ৬০,০০০/- (ষাট হাজার) টাকা বেতন গ্রহণকারী সম্পূর্ণ সুস্থ শিক্ষক মোঃ সামসুল আলমকে এই অবৈধ ও অন্যায় সুযোগ দিয়েছেন তৎকালীন উপাধ্যক্ষ ও দুর্নীতির দায়ে এমপিও বাতিল হওয়া মো. রায়হানুল ইসলাম।
ডিআরইয়ের প্রতিবেদনে মোঃ সামসুল আলম কোন ছুটিতে কিংবা অনুপস্থিতি থাকার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি এবং প্রক্সি ক্লাস নেওয়ার বিষয়েও গভর্নিং বডি কোন সিদ্ধান্তের রেজুলেশন দেখাতে পারেননি। বিষয়টি প্রমাণিত উল্লেখ রয়েছে।
কলেজটির একাধিক সূত্র বলছে, টানা ছয় বছর একজন শিক্ষক এভাবে নিজের ইচ্চেমত কলেজে না এসেও বেতন ভাতা উত্তোলন করেও তার এমপিও কিভাবে বহাল থাকে তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শিক্ষকরা মাউশির একটি নিয়মের মধ্যে থাকে। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে তাদের এমপিও বাতিল হবে যা নীতিমালায় সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিষয় শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।
২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কলেজটির গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আরকে চৌধুরী (রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি সভাপতি থাকাকালীন কিভাবে একজন শিক্ষক এভাবে ক্লাস না করিয়ে কলেজে না এসেও বেতন-ভাতা উত্তোলন এবং প্রক্সি শিক্ষককে দিয়ে ক্লাস করিয়ে তাকেও বেতন প্রদান করা হয় জানতে চাইলে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ডিআইএ বলছে, ডিআইয়ের প্রতিবেদনে অনিয়মের চিত্র উঠে আসলে সেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সেই প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডিআইএ তো কোন ব্যবস্থা নিতে পারে না। প্রতিবেদনে সুপারিশ করতে পারে। কলেজটির বিষয়ে সেই সুপারিশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের এমপিও বাতিল হয়েছে। বাকিদেরও বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হয়ত নিবেন প্রশাসন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত শিক্ষক সামসুল আলমের মুঠোফোনে কল করলে তিনি ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বিষয়টি জানিয়ে একাধিকবার ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তিন তা দেখলেও কোন প্রত্যুত্তর করেননি। তবে গত সোমবার শিক্ষাবার্তা'কে বলেছিলেন, তিনি কলেজে নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন, ক্লাস নিয়েছেন এবং নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেছেন। প্রক্সি ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ওয়ালিউল্লাহ তিনি প্র্যাকটিক্যালের ক্লাস নিয়ে থাকতে পারেন। তবে আমার ক্লাস নেননি। ডিআরইয়ের প্রতিবেদনে আপনি কোন ছুটি কিংবা অনুপস্থিতি থাকার বিষয়ে তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি এবং প্রক্সি ক্লাস নেওয়ার বিষয়েও গভর্নিং বডি কোন সিদ্ধান্তের রেজুলেশন দেখাতে পারেননি। বিষয়টি প্রমাণিত উল্লেখ রয়েছে। এসময় তিনি বলেন, কলেজে আসেন বিস্তারিত কথা হবে।
জানতে চাইলে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. জহিরুল হক মৃধার মুঠোফোনে কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির কলেজ ও প্রশাসন উইংয়ের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, মাউশির আকস্মিক পরিদর্শনে অনপস্থিত থাকা শিক্ষকদের শোকজ করা হয়েছে ইতিমধ্যে। আর এত বছর ধরে কেউ এমন করলে অবশ্যই বিধি লঙ্ঘন করেছেন। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।
আরও পড়ুনঃ
- অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ৩০ অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে!
- মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার এক মাস পার হলেও এমপিও বাতিল হয়নি অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের
- অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরতে দুই মাসেও অগ্রগতি নেই
- আর কে চৌধুরী কলেজ: তিন শিক্ষকের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার!
- আর.কে চৌধুরী কলেজ: দুর্নীতিতে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের চাকরি গেলেও বহাল সঙ্গীরা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/০১/২০২৪