জনমিতি ও নিষ্ক্রিয় যুবশক্তি
রাজেকুজ্জামান রতনঃ পরিসংখ্যানের গুরুত্ব কোনো পরিকল্পনাবিদ অস্বীকার করেন না। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিটা কেমন, কী হতে পারত কিংবা কোথায় আছি আর কোথায় যেতে চাই, তা নির্ধারণ করতে গেলে পরিসংখ্যান এবং তথ্য খুবই প্রয়োজন। পরিসংখ্যান নিয়ে নানা সন্দেহ থাকলেও কিংবা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থার পরিসংখ্যান বলে অনেকে উপেক্ষা করতে চাইলেও বিবিএসের মতো এত বড় অবকাঠামো আর কোনো সংস্থার নেই। তাই কোনো বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে হলে বিবিএসের পরিসংখ্যানকে ভিত্তি ধরাই গ্রহণযোগ্য এবং নিরাপদ। সম্প্রতি বিবিএস জরিপে এমন কিছু তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া দরকার। এর মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো, কর্মক্ষম জনসংখ্যা এবং নিষ্ক্রিয় তরুণ জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত। জনসংখ্যা সবসময় বিপদের কারণ নয়, যদি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আকার বড় থাকে তাহলে তা সুবিধাও এনে দিতে পারে। একে বলা হয়, জনমিতিক সুবিধা। বলা হয়, বাংলাদেশ এখন জনমিতিক সুবিধার কাল অতিক্রম করছে। অর্থাৎ দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা তাদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের চেয়ে বেশি। কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি হলে জনমিতির সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলেন, একটি দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) যদি বেশি থাকে এবং নির্ভরশীল জনসংখ্যা (শূন্য থেকে ১৪ ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী) যদি কম থাকে তাহলে বলা যায়, জনমিতির সুবিধা দেশটির অনুকূলে আছে।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়, সামাজিক বৈষম্য সত্ত্বেও পুঁজিবাদী পথে গত শতকের ষাট ও নব্বইয়ের দশকে হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা নিয়ে বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিবিএসের জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৬৫ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো কর্মক্ষম। ফলে জনমিতির সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে অনুকূল সময় বিরাজ করছে। তবে জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ কর্মক্ষম হলেই যে একটি দেশ জনমিতির সুফল নিতে পারবে, তা নয়। এ জন্য কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের উন্নতি করে বাংলাদেশ সেই সুবিধা কতটা কাজে লাগাতে পেরেছে বা পারছে? এই প্রশ্ন রয়েছে। প্রকৃতির নিয়মে জনমিতির সুবিধা চিরকাল থাকে না; বাংলাদেশও চিরকাল তা পাবে না। এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সুবিধা কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করাই শুধু প্রয়োজন তা নয়, স্বল্প মজুরি ও স্বল্প দক্ষতার কাজ পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটাবে না বরং শেষ বিচারে কর্মজীবী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়াবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষের হার গত পাঁচ বছরে কিছুটা কমেছে, যদিও এখনো তা উদ্বেগজনক নয়, তবে কমার প্রবণতাকে উপেক্ষা করা উচিত হবে না। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৬৫ দশমিক ০৮ শতাংশ; ২০১৯ সালে যা ছিল ৬৬ দশমিক ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর হার ১ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে ২০২৩ সালে দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ; ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। সেই হিসাবে বয়স্ক মানুষের হার বেড়েছে প্রায় ১ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শুধু ২০২২ সাল ছাড়া প্রতিবছরই ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের হার বেড়েছে। ২০১৯ সালে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠী ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০২১ সালে ছিল ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশে। সর্বশেষ গত এক বছরে এই হার কিছুটা দ্রুত বেড়ে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশে উঠেছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫০ বছরের বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর হারও বেড়েছে। ২০১৯ সালে দেশে ৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সের মানুষের হার ছিল মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশে উঠেছে। এ কারণে দেশে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর হারও বেড়েছে। ২০১৯ সালে নির্ভরশীল প্রবীণ ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই প্রবণতা একটা সতর্ক সংকেত হিসেবে না নিলে সমাজে একটা বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে। কারণ জনমিতির সুবিধা কতদিন পাওয়া যেতে পারে তার একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী যত দিন পাওয়ার কথা ছিল, তার মধ্যে অনেকটা সময় ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে। বয়স্ক জনগোষ্ঠী বাড়ছে এবং আগামী ১৫-২০ বছরে আরও বাড়বে। তাদের কর্মক্ষমতা কমবে কিন্তু ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো যেমন চিকিৎসা, সেবা যতœ খরচ বাড়বে। সে দায়িত্ব নেবে কে? আর এখন যে তরুণ জনগোষ্ঠী আছে দক্ষতা, যোগ্যতা বাড়াতে মানসম্মত শিক্ষা, উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হবে। সেই দায়িত্বই বা কে পালন করবে?
শিক্ষা ক্ষেত্রে জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে কি এই অভীষ্ট অর্জন করা সম্ভব? কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ যদি শিক্ষা প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানে না থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে জনমিতির এই সুবিধা কাজে লাগাব? ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৮ শতাংশ তো দূরের কথা, অন্তত বর্তমানের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪ ভাগ বরাদ্দ করতে পারা বর্তমান ব্যবস্থাতেও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। আর একটি উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৪১ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। এর অর্থ হলো তারা সমাজে আছে কিন্তু পড়াশোনায় নেই, কর্মসংস্থানে নেই; এমনকি কোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন না। মেয়েদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার হার বেশি, ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ছেলেদের মধ্যে এ হার কম, ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ধরনের নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা বাড়ছে। এসভিআরএস-২০২১ অনুযায়ী, তখন নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ছিল ৩৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এক বছরে তা প্রায় ১ শতাংশ বেড়েছে। এসডিজির নানা পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ সত্ত্বেও এই বৃদ্ধি কেন ঘটছে তা বিশ্লেষণ করা দরকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২২ প্রতিবেদনে নিষ্ক্রিয় তরুণের এই হার তুলে ধরা হয়েছে। বিবিএস নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ধরেছে ১৫ থেকে ২৪ বছর। সংখ্যার হিসাবে দেখা যায়, নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ। অর্থনীতিবিদ ও শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়েদের বাল্যবিবাহ, কাজ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানে ঘাটতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, শোভন কাজের অভাব ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘বৈশ্বিক কর্মসংস্থান নীতি পর্যালোচনা-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত একটি দেশ যত উন্নত হতে থাকে তত সে দেশে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার কমতে থাকে। নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা বেশি হয় উন্নয়নশীল ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের মতো ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে হারটি উচ্চ। ২০০৫ সালে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার গণনা শুরু হয়। ২০২০ সালে বিশ্বে এ হার ছিল সর্বোচ্চ প্রায় ২৫ শতাংশ। এর অন্যতম কারণ ছিল করোনা মহামারী। ২০২২ সালে তা কমে সাড়ে ২৩ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয়তার হার আন্তর্জাতিক হারের চাইতে অনেক বেশি।
অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় তরুণরা কিন্তু নিষ্ক্রিয় নয়। তাদের উদ্দেশ্যহীন তৎপরতা নানা সামাজিক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধী চক্রের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে তারা এবং ব্যবহৃত হচ্ছে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে। এখন এই যে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ‘কিশোর গ্যাং’
সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তার একটি প্রধান কারণ নিষ্ক্রিয় তরুণদের সংখ্যা বৃদ্ধি। এ ধরনের তরুণদের নাম কেউ বলছেন বিচ্ছিন্ন, কেউ বলছেন বিযুক্ত যুবসমাজ। কি নিদারুণ ব্যাপার! যাদের রয়েছে সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা, যাদের থাকার কথা চোখভরা স্বপ্ন, যাদের থাকার কথা পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তারা এখন নিষ্ক্রিয়, হতাশ এবং উদাসীন। উদাসীন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে, উদাসীন সমাজের প্রতি। ফলে এই বিপুলসংখ্যক সম্ভাবনাপূর্ণ যুবগোষ্ঠী আজ পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝার মতো। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এই যুবসমাজের মধ্যে চার ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ১. মানসিক বিষন্নতা। ২. মাদকাসক্তি। ৩. পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতায় জড়িত হওয়া এবং ৪. উগ্রবাদের দিকে ঝোঁক। এটি ভবিষতে সমাজের জন্য এক ভয়ংকর বিপদ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কোনো দেশেই নিষ্ক্রিয় বা বিযুক্ত যুবসমাজের হার বেড়ে যাওয়ার পরিণতি ভালো নয়। সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত, বেপরোয়া মনোভাব এবং উদ্দেশ্যবিহীন জীবনযাপনের প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে এ ধরনের যুবশক্তি। সরকারের কোনো দুর্বলতার কথা উল্লেখ করলে রোষানলে পড়া বা বিদ্রুপের শিকার হওয়ার ভয়ে অনেকেই কথা বলতে চান না। কিন্তু জরিপের তথ্য দেখাচ্ছে, দেশে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু কমছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। এটা রোগের লক্ষণ কিন্তু কারণ নয়। বেকারত্ব ও বিযুক্তির কারণ হলো শোষণ এবং শোষণ সৃষ্ট বঞ্চনা। আর এর সঙ্গে দুর্নীতি ও দুঃশাসন যুক্ত হয়ে রোগ ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলে। উন্নয়নের সঙ্গে বঞ্চনা যদি বাড়ে তাহলে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেবে। স্বপ্নহীন ও নিষ্ক্রিয় তারুণ্য নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
লেখক: রাজনীতিবীদ ও কলামিস্ট
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০৩/২০২৪