ওপরে চোর-পুলিশ, নিচে শিশুদের শ্রেণিকক্ষ, আতঙ্গে শিক্ষার্থীরা
শরীয়তপুরঃ সশস্ত্র পুলিশ। হাতকড়া পরানো আসামি। হরহামেশা বহিরাগতদের আসা-যাওয়া। সময়-অসময় সিঁড়ি বেয়ে আসামি-পুলিশের ওঠানামা। স্কুলমাঠ ভর্তি আসামির স্বজনদের সমাগম। শ্রেণিকক্ষ সংকট। শিক্ষকদের বসার জায়গাও অপ্রতুল। ক্লাস চলাকালে মেশিন চালু থাকে পুলিশ ফাঁড়ির। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর একেঅপরের কথা কানেও পৌঁছায় না। সব মিলিয়ে ভয় ও আতঙ্কগ্রস্ত কোমলমতি শিশুরা। বছরে বছরে কমছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীর সংখ্যাও!
১১১নং উত্তর হালইসার গোয়ালবাথান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার এ বিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালে স্থাপিত। শুরুতে এটি ছিল টিনশেড ঘর। ২০০২ সালে প্রথম তলায় চারটি কক্ষ ও দ্বিতীয় তলায় চারটি কক্ষ বিশিষ্ট দোতলা পাকা ভবন নির্মিত হয়। এ বিদ্যালয়ে ১৫৬ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন ৫ শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষের অভাবে ৩ শিক্ষকের বেশি একসঙ্গে ক্লাস নিতে পারেন না। নেই কোনো দপ্তরি। তাই নিজেরাই ঘণ্টা বাজিয়ে ক্লাসের সময় শুরু ও ছুটির জানান দেন শিক্ষকরাই।
পদ্মা নদীর পাড়ে সুরেশ্বর বাজার। এ বাজারে ৩৫ বছর আগে নৌপুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। ২০০৩ সালে নদী ভাঙনের শিকার হয় নৌপুলিশ ফাঁড়িটি। এ সময় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয়তলা অস্থায়ীভাবে ব্যবহার শুরু করে নৌ পুলিশ। তবে অস্থায়ী বসবাসেই পেরিয়ে গেছে ২০ বছরের অধিক সময়। ফলে ভবনের ওপর তলায় পুলিশ ফাঁড়ি ও নিচতলায় চলে শিক্ষা কার্যক্রম।
শ্রেণিকক্ষ সংকটের মধ্যেই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০ বছর ধরে নৌপুলিশের বাস। যে কারণে প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকরা বসেন একই কক্ষে। নেই কোনো মালামাল রাখার ঘর, তাইতো আসবাবপত্রসহ সব কিছুই ঠাঁই হয়েছে শিক্ষকদের কক্ষে। শ্রেণিকক্ষে বসানো হয়েছে ফাঁড়ির কাজে ব্যবহারের জন্য ইলেকট্রিক মটর। অসাবধানতাবশত ঘটতে পারে ইলেকট্রিক দুর্ঘটনা। নৌপুলিশ ফাঁড়িটির কারণে নানা সমস্যায় বিদ্যালয়টি পাঠদান অনেকটা অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দ্রুত ফাঁড়িটি সরিয়ে নেয়ার দাবি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
বিভিন্ন সময়ে ফাঁড়িতে ধরে আনা আসামি, সশস্ত্রপুলিশ ও অপরিচিত লোকদের আসা-যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের আতঙ্কিত হয়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যার কথা জানান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলে, ‘যখন আসামিদের ধরে নিয়ে আসা হয়, তখন বিভিন্ন মানুষে পুরো মাঠটি ভরে যায়। তখন আমরা অনেক ভয় পাই এবং মাঠে খেলাধুলা করতে পারি না।’
চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নিলয় বলে, ‘পুলিশ যখন লাঠি বা অস্ত্র নিয়ে আসামিসহ ফাঁড়িতে আসে তা দেখে আমরা খুব ভয় পাই।’
আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাদের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলাকালীন অবস্থায় ইলেকট্রিক মটর চলতে থাকে। মটরের বিকট শব্দে আমরা ম্যাডামের কথা শুনতে পাই না। আমাদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটে।’
বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেন, যখন হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আসামিদের নিয়ে আসে এবং সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠানো হয়, তখন কোমলমতি শিশুরা সশস্ত্র পুলিশ, আসামিদের বিকট চেহারা ও বহিরাগতদের আগমনে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে যায়। গত তিন থেকে চার বছরে আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে এর একটি সমাধান চাই।
স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘ফাঁড়ির পুলিশ যখন দলবেঁধে আসামিদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফাঁড়িতে নিয়ে আসে, তখন সে দৃশ্য দেখে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অনেক ভয় পায়। সে দৃশ্য দেখে অনেকেই বাড়িতে তাদের বাবা-মাকে বলে যে সে আর স্কুলে আসতে চায় না। আমরা বারবার লিখিত ও মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে অবগত করলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান না করা হলে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন আরও কমে যাবে।’
নড়িয়া উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ছানোয়ার হোসেন বলেন, মৌখিক ও লিখিতভাবে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত আমাদের সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছি এবং ফাঁড়িটি সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু আমাদের সেই আবেদন আজও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
দ্রুত সময়ের মধ্যে ফাঁড়িটি সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ এই শিক্ষা কর্মকর্তার।
শরীয়তপুর সুরেশ্বর নৌপুলিশ ফাঁড়িটি চাঁদপুর নৌ পুলিশ অঞ্চলের আওতাধীন একটি ফাঁড়ি। এ ফাঁড়িটি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে চাঁদপুর অঞ্চলের নৌপুলিশ সুপার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আমাদের ফাঁড়িটি ২০০৩ সালে পদ্মা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। এরপরে আমরা ওই স্কুল ভবনে অস্থায়ী হিসেবে দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করি। অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই আমরা এখানে থাকছি। তবে স্থায়ীভাবে ফাঁড়ি নির্মাণের জন্য আমাদের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শেষে ভবন নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমাদের সুরেশ্বর ফাঁড়িটি আমরা স্থানান্তর করতে পারব। অথবা কোনো ব্যক্তিগত ভবন তৈরি করে আমাদের ভাড়া দিলে আমরা ফাঁড়িটি স্থানান্তর করব। বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অস্থায়ীভাবে এ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হবে। সূত্রঃ সময় সংবাদ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৯/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়