উচ্চশিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ
ড. মো. আনিসুজ্জামান ।।
বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় অগ্রযাত্রায় গতি সংযোজনের জন্য মানসম্মত মানবিক দক্ষ জনশক্তি সর্বাগ্রে অগ্রাধিকারযোগ্য। দক্ষ ও মানসম্মত জনশক্তিকে মানবিক শক্তিতে পরিণত করা না হলে মানবিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। সুস্থ, মানবিক ও যৌক্তিক সমাজ গঠনে মানবিক উন্নয়নের বিকল্প কিছু এখনো পর্যন্ত সমাজ গবেষকরা উদ্ভাবন করতে পারেননি। কোনো পরীক্ষিত মডেলকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। বাংলাদেশে নিজস্ব মডেলে উন্নয়ন হচ্ছে। অতিবাম ও ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ বিশ্লেষকদের কাছে বাংলাদেশ মডেলের উন্নয়ন দৃষ্টিগোচর হলেও বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন।
উন্নয়নকে তাঁরা শুধু অস্বীকার করেন না, যেকোনো প্রক্রিয়ায় লাল-সবুজের অদম্য অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তরুণসমাজকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁদের মোহনীয় মনোমুগ্ধকর বাণীতে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হলেও সবাই প্রতারিত হয় না। তথ্য গোপন করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণকারীদের হুংকার বাঙালি মানস গ্রহণ করেছে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাস সমর্থন করে না। ফানুসের মতো তাঁদের সাহসী উচ্চারণ মিডিয়ায় স্থান পায়, কিন্তু গণমানুষের মনোজগতে পৌঁছানোর আগেই তা হাওয়ায় মিশে যায়।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামোর বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি, শিক্ষকদের চেম্বার, শিক্ষার্থীদের হলে পর্যাপ্ত আবাসন ও সেমিনার রুমের স্বল্পতা প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয়। হলের বারান্দায় ও গণরুমে মানবেতর জীবনযাপন করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে ন্থান পাওয়া দুষ্কর। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অধ্যাপকের বসার জন্য নিজস্ব রুম নেই। মেডিক্যাল কলেজগুলোর অবস্থা বর্ণনাতীত। ক্লাসরুমে আসনের চেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের বসার কোনো নির্ধারিত স্থান নেই। অনেক শিক্ষকের বসার রুমই বিভাগীয় সভাপতির কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমন পরিস্থিতিতে নতুন নতুন বিভাগ চালু করার ব্যাপারে উপাচার্য মহোদয়রা কখনো কখনো অতি উৎসাহী থাকেন। শোনা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য মেয়েকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগদানের জন্য নতুন একটি বিভাগ খুলেছিলেন। এ কাজে পিছিয়ে নেই অতি আদর্শবাদী বাম ও ডানপন্থী সিনিয়র শিক্ষকরাও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বেকারত্ব কমিয়ে আনার জন্য আসনসংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, কিছু বিভাগ আছে যেগুলোর আসনসংখ্যা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, সেগুলো কমিয়ে আনা হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা রয়েছে এবং যেগুলো থেকে পাস করে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার সুযোগ রয়েছে, সেগুলো বৃদ্ধির কথা তিনি বলেছেন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণ করা উচিত। বাঙালি জাতির মঙ্গলের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি থেকে দিকনির্দেশনা অতি জরুরি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বড় ভাই-বোনদের নোটের ওপর নির্ভরশীল। কখনো কখনো নোটগুলো ফটোকপির দোকানে পাওয়া যায়। ফলে শিক্ষার্থীদের কষ্ট করে বড় ভাই-বোনদের কাছে যেতেও হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো সিনিয়র শিক্ষক কখনো কখনো বিশেষ কোনো ফটোকপির দোকানের রেফারেন্স দেন শিক্ষার্থীদের। উচ্চশিক্ষা হয়ে পড়েছে ফটোকপি শিটের ওপর নির্ভরশীল। অনেক শিক্ষার্থী রসিকতা করে এই শিক্ষার নাম দিয়েছেন ‘শিট দর্শন’।
মৌখিক পরীক্ষার সময় দেখা যায় শিক্ষার্থী জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হলেও একেবারে মৌলিক সাধারণ প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারেন না। যেমন—বিংশ শতাব্দীর নীতিদার্শনিক আর এম হেয়ারের মতবাদ সম্পর্কে বলতে পারেন; কিন্তু আর এম হেয়ার কে ছিলেন? কী করতেন? এগুলোর উত্তর মেলে না। ফটোকপি শিটের মধ্যে আর এম হেয়ারের জীবনবৃত্তান্ত নেই। পদার্থবিজ্ঞানের এমএসসি শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বলতে পারেন না পদার্থবিজ্ঞানের জনক কে? ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সরদার ফজলুল করিমের নাম পর্যন্ত জানেন না। কেননা এগুলো বড় ভাই-বোনদের শিটের মধ্যে নেই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণের সঙ্গে শিক্ষা সংকোচন নীতির কোনো সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয় না। গাইড বই, নোট বই আর বড় ভাইদের শিটের ওপর নির্ভর উচ্চশিক্ষার বাস্তব মূল্য কতটুকু যৌক্তিক? কৃষকের সন্তান জানে না তার বাবা জমিতে কোন সময় কী ধান চাষ করেন। জীবন-জীবিকা বিচ্ছিন্ন কেরানি তৈরির মানসিকতা নিয়ে উচ্চশিক্ষার প্রসার জাতীয় অপচয় ছাড়া অন্য কিছু নয়। শিক্ষা ও গবেষণা উচ্চশিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলেও ইউজিসির এক রিপোর্টে দেখা যায়, আটটি পাবলিক ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় করেনি।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গবেষণামূলক আন্তর্জাতিক মানের কোনো প্রকাশনা নেই। কোনো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাবলিকেশনের চেয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রকাশনাগুলো এখনো পর্যন্ত অনলাইনভিত্তিক করার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যায় না। একেবারে যে অনলাইনে নেই, তা-ও নয়। অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট উদ্যোগী হয়ে অনলাইনে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশকে সত্যিকারে ডিজিটাল দেশে রূপান্তর করার জন্য গবেষণামূলক প্রকাশনাগুলো দ্রুত অনলাইনভিত্তিক করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এ ব্যাপারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কোনো কারণ দেখি না।
উন্নয়নের পূর্বশর্ত মানুষ। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের জন্যই উন্নয়ন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা পুনর্নির্ধারণ করতে গিয়ে যান্ত্রিক শিক্ষার সঙ্গে মানবিক শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রযুক্তিনির্ভর চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানুষকে যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করার আশঙ্কা রয়েছে। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনায় মানববিদ্যা হ্রাসের ফলে যান্ত্রিক মানুষ সৃষ্টির সম্ভাবনাই বেশি থাকে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় হতদরিদ্র মানুষের ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই মানববিদ্যার শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়