অধ্যক্ষসহ পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা
সাতক্ষীরাঃ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রতারণা, জালিয়াতি ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে কনিষ্ট শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়েরকৃত মামলায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদসহ পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরার বিশেষ আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ চাঁদ মো. আব্দুল আলীম আল রাজী দুদকের দায়েরকৃত অভিযোগপত্র পর্যালোচনা শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে এ পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।
এদিকে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারির খবর পেয়ে সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদ কলেজ পরিচালনা পর্ষদের এক সাবেক সভাপতির কাছে থলে-বোচকা নিয়ে ছুটে যান। তবে ওই নেতা ও জনপ্রতিনিধি নীরব ভূমিকা পালন করেন।
সাতক্ষীরা আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে চার প্রভাষককে এমপিওভুক্ত করার মাধ্যমে ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আশাশুনি উপজেলা কচুয়া গ্রামের ও বর্তমানে শহরের পলাশপোল মধুমল্লারডাঙির বাসিন্দ্রা সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাঈদ, দেবহাটা গ্রামের উত্তর পারুলিয়া গ্রামের দেলবার মৃধার ছেলে সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলাম, আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ সরদারের ছেলে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এসএম আবু রায়হান, সদর উপজেলার নেবাখালি গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে দর্শণ বিভাগের প্রভাষক নাসির আহম্মেদ এবং সদর উপজেলার গোপীনাথপুর গ্রামের ধীরেন্দ্র্র নাথ সরকারের ছেলে হিসাব বিজ্ঞানের প্রভাষক অরুন কুমার সরকারের বিরুদ্ধে দুদকের গ্রপ্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস ২০২২ সালের ৯ মার্চ খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা (৩/২০২২)দায়ের করেন। যা পরবর্তীতে সাতক্ষীরা বিশেষ আদালতে ২/২০২২ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা দুদকের খুলনা অফিসের সহকারি পরিচালক বিজন কুমার রায় চলতি বছরের ৫ মে আদালতে ওই পাঁচ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর থেকে ২ অক্টোবর সোমবার পর্যন্ত আদালতে তিনটি ধার্য দিনে আদালতে অভিযোগপত্রটির আমল গ্রহণ শুনানী হয়নি। গত ২ অক্টোবর শুনানি না হলে ২৬ অক্টোবর পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরার বিশেষ আদালতের দুদকের পিপি এড. আসাদুজ্জামান দিলু বলেন, বৃহদাকার স্পেশাল ২/২০২২ নং মামলাটির আমল গ্রহণ করে সকল আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারির নির্দেশ দিয়েছেন বিশেষ আদালতের বিচারক চাঁদ মো. আব্দুল আলীম আল রাজী। শুনানীর জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য ছিল। সেক্ষেত্রে আসামীদের আদালতে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে তাদেরকে কারাগারে যেতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
প্রসঙ্গত, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে রেজুলেশন জালিয়াতি করে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে ২৪ জন শিক্ষক নিয়োগ ও ২১জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১৫আগস্ট সাতক্ষীরায় এসে তদন্ত শুরু করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক প্রবীর কুমার দাস। ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে সাতক্ষীরা এলজিইডি অফিসের রেস্ট হাউজে ডেকে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দুর্নীতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য অবগত হন।
অভিযুক্ত ২১জন প্রভাষক ও অধ্যক্ষ আবু সাঈদকে ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েক দফায় দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নেওয়া হয় তাদের লিখিত জবানবন্দি। পরবর্তীতে বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. মনিরুল ইসলাম, দর্শণ বিভাগের গ্রপ্রভাষক নাসির আহম্মেদ, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক এস্এম আবু রায়হান এবং হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অরুন কুমার সরকারের কাগজপত্র জাল বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়।
২০১৯ সালের ২৪ জুলাই দুদকের হটলাইনে সিটি কলেজের এমপিও বঞ্চিত এবং কলেজ থেকে নিয়মবহির্ভুতভাবে বিতাড়িত বিধান চন্দ্র্র দাসসহ অন্যান্যদের অভিযোগের পর তদন্ত প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারির পর থেকে এসকল শিক্ষকদের তদন্ত কর্মকর্তার মুখোমুখি হতে হয়। অভিযুক্ত চারজন প্রভাষকের অনার্স শাখায় নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য জালিয়াতি করে ডিগ্রীর তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য ২০০৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি ওই বছরের ২৯ নভেম্বর নিয়োগ বোর্ড গঠণ করা হয়।
৪ ডিসেম্বর এক পরিপত্রে উক্ত বোর্ডের মাউশি প্রতিনিধি হিসেবে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি এলপিআরে যাওয়া অধ্যক্ষ সুকুমার দাসকে ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি দেখানো হয় যুদ্ধাপরাধী মামলায় তৎকালিন জেলে থাকা আসামী মাওলানাা আব্দুল খালেক মন্ডলকে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি উপরোক্ত চারজন শিক্ষককে ২০০৯ সালের ৬ ডিসেম্বর নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়। যদিও ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ওই চার প্রভাষকের নিয়োগকালে খালেক মন্ডল সভাপতি ছিলেন না। ২০০২ সালের ২৪ জুন থেকে ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত খালেক মন্ডল সভাপতি ছিলেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, তৎকালিন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হকের সময় ওই চারজন প্রভাষকের নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন দেখালেও শুধুমাত্র কৃষি ডিপ্লোমার শিক্ষক আবু রায়হান ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ২০০৫ সালে। অন্য তিনজনের রেজুলেশন তার নয় বলে তদন্তে জানা যায়। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রুপালী ব্যাংকের সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে সিটি কলেজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন তালিকায় অধ্যক্ষ হিসেবে ইমদাদুল হক ও সভাপতি হিসেবে তৎকালিন সাংসদ এমএ জব্বারের সাক্ষর দেখা যায়।
মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়, ব্যানবেইস এর তথ্য অনুসারে মো. মনিরুল ইসলামের প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। এসএম আবু রায়হানের যোগদানের তারিখ ২০০৫ সালের ১৭ মার্চ। মো. নাসির আহম্মেদ এর প্রকৃত যোগদানের তারিখ ২০১৬ সালের পহেলা ডিসেম্বর ও অরুন কুমার সরকারের যোগদানের তারিখ ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এইসব শিক্ষকদের যোগাদানের তারিখ জালিয়াতি করে মনিরুল ইসলাম ও অরুন কুমার সরকারের যোগদান ২০০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর, এসমএম আবু রায়হান ও নাসির আহম্মেদ এর যোগদান দেখানো হয়েছে ২০০৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর।
মাউশি’র ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পরিপত্রে উল্লেখ করা হয় যে, ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির পূর্বে ডিগ্রী স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। এই পরিপত্র জারির পরপরই অধ্যক্ষ আবু সাঈদ ওই চার শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তির জন্য অফ লাইনে মাউশি বরাবর আবেদন করেন। এরই আলোকে তারা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে এমপিওভুক্ত হন। অধ্যক্ষ আবু সাঈদের যোগসাজসে ওই চারজন শিক্ষক ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বেতন ভাতা বাবদ ২০ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯৬ টাকা রুপালী ব্যাংক সাতক্ষীরা কর্পোরেট শাখা থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
সূত্রটি আরও জানায়, বর্তমানে আরও ১২জন শিক্ষকের তথ্য জালিয়াতি করে এমপিওযোগ্য নামের তালিকাভুক্ত করার অভিযোগে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই থেকে ১২ জুলাই দুদকের গ্রপ্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক ও অনুসন্ধানী কর্মকর্তা তাদেরকে ডেকে নিয়োগ সংক্রান্ত সকল তথ্য উপাত্ত রেকর্ড করেন। এছাড়া চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আজিম খান শুভসহ চারজনের নামে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তাদের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা ও বেতন ভাতা গ্রহণের পরিমান জানতে চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিয়ন, নাইট গার্ড থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১০ লাখ টাকা থেকে ৩৫ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারার এক অলিখিত সিস্টেম গড়ে উঠেছে। আর এই সিস্টেমের বলি হয়ে বছরের পর বছর বিনা বেতনে চাকুরি করে বহু ননএমপিওভুক্ত শিক্ষক এমপিওভুক্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পথে পথে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি ব্যবসার এই টাকা বড় অংশ চলে গেছে জনপ্রতিনিধি নামক রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে। কথিত আছে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তারী পরোয়ানা পেয়ে পলাতক হওয়া এই অধ্যক্ষ সাতক্ষীরার অপর একটি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদ ছেড়ে ৩৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সিটি কলেজে যোগ দেন চুকিয়ে নিয়োগ বানিজ্য করার জন্যে। অধ্যক্ষ হিসেবে তার দায়িত্বকালে অসংখ্য ননএমপিও শিক্ষককে জালজালিয়াতি করে তিনি পথে বসিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়