ঢাকাঃ রাজধানীর পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রায় দুই মাস আগে নতুন অধ্যক্ষ যোগ দিয়েছেন। এতদিন গভর্নিং বডির সভাপতিসহ কয়েকজন সদস্যের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। এখন সভাপতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নতুন অধ্যক্ষ। তারা ইচ্ছেমতো শিক্ষকদের বদলি করছেন, পছন্দের লোককে নতুন দায়িত্ব দিচ্ছেন। স্বেচ্ছাচারে প্রতিষ্ঠানটির কাহিল দশা।
শিক্ষকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গভর্নিং বডির সভাপতি হচ্ছেন। তাদের শিক্ষার সঙ্গে আগে তেমন সংযোগ ছিল না। হঠাৎ করেই তারা বড় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়ে নানাভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষমতার দাপট দেখানোর চেষ্টাও আছে।
অবশ্য অধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমান খান বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার পুরোটাই মিথ্যা। প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর কিছু ব্যক্তি নানা ধরনের অভিযোগ করছে।’
জানা যায়, ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১৪৪ ধারা ভেঙে অনৈতিকভাবে ছাত্রদের নকল সরবরাহের চেষ্টা চালান বর্তমান গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য। এতে বাধা দেন সাবেক অধ্যক্ষ ড. মুন্সি শরিফুজ্জামানসহ কয়েকজন শিক্ষক। ব্যাপারটি জানাজানি হলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় গভর্নিং বডির একজন সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করা হয়। এর জেরে সাবেক অধ্যক্ষকে স্কুল থেকে সরানো হয় বলে দাবি শিক্ষকদের।
মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি আবদুল মতিন ভূঁইয়া, যিনি বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। গত ৩০ মার্চ প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান খান। মতিঝিলে প্রতিষ্ঠানটির মূল ক্যাম্পাসের পাশাপাশি বাসাবোতে একটি শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী প্রায় ১২ হাজার।
গত ১৮ মে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম তুলে ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে লিখিত অভিযোগ জমা দেন শিক্ষক মো. রুহুল আমিন। তিনি ১৬টি অভিযোগ তুলে ধরেন।
সভাপতি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো মিথ্যা। তবে আমরা নিতান্ত প্রয়োজনে কিছু শিক্ষককে সমন্বয় করেছি। এতে হয়তো তাদের শাখা বা শিফট পরিবর্তন হয়েছে। এটা সাময়িকভাবে করা হয়েছে। সমস্যা মিটে গেলে তাদের আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’
অভিযোগে বলা হয়, নতুন অধ্যক্ষের যোগদানের এক মাসের মধ্যেই শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সভাপতির সিন্ডিকেট। ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষকের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে মিথ্যা অভিযোগও করা হয়েছে। ফলে শিক্ষকরা ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেয়ে চাকরি টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে লেখাপড়া।
আরও বলা হয়, সম্প্রতি শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেনকে (ইসলাম শিক্ষা) দিবা থেকে প্রভাতি শাখায়, প্রভাতি শাখার শিক্ষক মাহমুদুল হাসানকে (ইসলাম শিক্ষা) দিবা শাখায় ও শিক্ষক রুহুল আমিনকে (প্রাথমিক) বাসাবো থেকে মূল ক্যাম্পাসে আনা হয়। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করলে আরও কয়েকজনকে বদলি করা হয়। মূল শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখাপ্রধান (প্রাথমিক) রমেশচন্দ্র বিশ্বাসকে সরিয়ে ভাউচার মাস্টার হিসেবে পরিচিত আনিসুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে মূল শাখার মাধ্যমিক শাখার ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আক্তারি বেগমের জায়গায় সভাপতির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ইউসুফ মিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনো শিক্ষককে মূল ক্যাম্পাস থেকে শাখায় বদলি করা বিধিবহির্ভূত। শাখা ও মূল স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ পৃথকভাবে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান গভর্নিং বডির সদস্য এনামুল হক ও কামরুজ্জামান শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির তালিকা তৈরি করছেন। আবার টাকার বিনিময়ে এ বদলি ঠেকানোর ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সভাপতি ও অধ্যক্ষের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বাসাবো শাখার প্রাথমিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত শাখা প্রধান মো. কবির আহমেদ এবং মো. দেলোয়ার হোসেনের পদ দুটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। অথচ মূল ক্যাম্পাসে ওই পদ দুটি বহাল রয়েছে। শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক আনিসুল ইসলামকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে তার মূল কাজ অ্যাসেমব্লি এখন হচ্ছে না।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান সভাপতি প্রতিটি কথায় একজন মন্ত্রীকে তার কাছের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি যাই করেন কিংবা করবেন তার জন্য তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না বলেও জানান। অধ্যক্ষও দম্ভ করে বলেন, তিনি মতিন ভূঁইয়ার সহযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। এখান থেকে সহসা যাচ্ছেন না। শিক্ষক-কর্মচারীরা তার কথা শুনতে বাধ্য।
সম্প্রতি প্রভাতি শাখার শিক্ষক সুলতানা নার্গিস স্কুল চলাকালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে অধ্যক্ষ তাকে ছুটি দেননি। বরং জোর করে পরীক্ষার ডিউটি করাতে বাধ্য করেন। ফলে তিনি শ্রেণিকক্ষেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগে বলা হয়, সাবেক অধ্যক্ষ গাড়ি মেরামত বাবদ ৬০ হাজার টাকার দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। সেই কাজ বর্তমান অধ্যক্ষ করেছেন ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/০৫/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়