অলোক আচার্য।।
শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার এবং আমাদের দেশে বহু ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা,মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ করছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার প্রসারে,মান সম্মত শিক্ষা প্রদানে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আছে বলেই প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশে লেখাপড়া করতে পারছে। তবে সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে সমানভাবে ভালো পরিবেশ বজায় রাখতে পারছে তা নয়। আবার দক্ষ শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে।
কিন্তু শিক্ষা প্রসারের কাজটি ভালোভাবেই করে চলেছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত কর্মরত রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষক। এর সাথে রয়েছে কর্মচারী। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানেরও একটি বড় উৎস এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করেই বহু পরিবার চলছে। গত দুই বছর করোনার সময় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মানুষগুলোই ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্দশায়।
শিক্ষার মূল কাজটি তারা নিরলসভাবে করছেন। দেশে অলিতে গলিতে গড়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। তাদের সবার শিক্ষা মান যে সমান তা নয়। সব প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি আদায়ের পরিমাণও সমান নয়। দেশের এসব বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একই সাথে মাধ্যমিক এবং উ”চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু রয়েছে। অনেক বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেতন, পরীক্ষার ফি ও অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন নেওয়া হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি অনেক বেশি।
যে ব্যয় বহন করা সাধারণ পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে শিক্ষা দিতে সব অভিভাবকই চায়। এক্ষেত্রে নামীদামী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করান। কিন্তু ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকের পক্ষেই তা অতিরিক্ত চাপ হয়ে দেখা দেয়।
শিক্ষা প্রদান একটি সেবামূলক কাজ হলেও বিষয়টি আজ রীতিমত বাণিজ্যিক একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা এবং বাণিজ্য পাশিপাশি চলতে পারে না। এখান থেকে শিক্ষাকে বের করে আনতে হবে। শিক্ষা একটি সেবা। এর মধ্যেই শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। শিক্ষা মূল উদ্দেশ্য অর্জনে ব্রতী হতে হবে।
আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে থেকেই শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভালো ফলাফল করার আশ্বাসেই অনেক প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রী ভর্তি করছে। মূলত মানস্মত শিক্ষার চেয়ে ভালো ফল করানোই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের। এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দেশে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। একটা প্রতিষ্ঠানের গা ঘেষে আরেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই কেবল একটি বিশাল বিল্ডিং ভাড়া করে গড়ে উঠছে। সেখানেই রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শাখাও! এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটাই লক্ষ ভালো ফল করানো। ভালো ফলের জন্য অভিভাবকদের কাছেও এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদা রয়েছে। তারা যেকোনোভাবে সন্তানকে এখানে পড়াতে চান।
ভালো ফলের জন্য রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানেই আবার রয়েছে আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা। সেখানেও রয়েছে মোটা অংকের অর্থ আদায়। টিউশন ফি, কোচিং ফি এবং অন্যান্য ফি মিলিয়ে মাসে মোটা টাকা গুণতে হয় অভিভাবককে। এখন যারা সেখানে পড়ছে তারা চাপ হলেও ভালো পড়ার জন্য পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে ইচ্ছা মতো ফি আদায় না হয়ে যদি সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই টিউশন ফি দিতে হতো অর্থাৎ এসব ইচ্ছে মতো ফি আদায় বন্ধে বহুদিন থেকেই অভিভাবকদের একটা আশা ছিল। অবশেষে এ বিষয়ে একটি আশার আলো দেখা গেছে।
দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়ের অনিয়মের লাগাম টানতে উদ্যোগী হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশের বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি বন্ধে এমন উদ্যোগ অভিভাবকদের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং সব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের একটি নীতিমালায় আনা সম্ভব হবে।
বিভিন্ন সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত বেতনসহ অন্যান্য ফি আদায় বন্ধে নির্দেশনা জারি করে সরকার। কিন্তু তাতে খুব বেশি ফল হয়নি। যেমন চলছিল বেশিরভাগক্ষেত্রেই তেমনই চলছে। এ কারণে শিক্ষা আইনের খসড়াতেও প্রতিষ্ঠানের ফি আদায়ে লাগাম টেনে ধরার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় সব ধরনের শিক্ষা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। সব ধরনের শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হবে এবং লেনদেন করতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে।
যা স্ব”ছতা বজায় রাখবে। মোট কথা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফি আদায় সব প্রতিষ্ঠানে একই হবে অর্থাৎ নির্ধারিত হারেই নিতে হবে।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ধাবিত হচ্ছে ফলাফলভিত্তিক। অর্থাৎ কে জিপিএ পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে না। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কত বেশি জিপিএ পায়। ভালো-মন্দ এখানেই নির্ধারিত হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা কি কেবল জিপিএ এর মধ্যেই আটকে থাকে। এই জিপিএ এর কারণে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমত যুদ্ধ হয়। এটা রীতিমত দেশের অভিভাবকদের কাছে মানসম্মানের ব্যাপার। সন্তান যদি জিপিএ ফাইভ না পায় তাহলে পাড়া মহল্লাাসুদ্ধ মানুষ গালমন্দ করতে থাকে।
এমনকি নিজের মা বাবার মুখটাও সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে। কয়েক বছর ধরে মানে জিপিএ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই এ রকম একটা ব্যাপার চোখে পরছে। দিনে দিনে সেটা আরও তীব্র হচ্ছে । আগামী বছর থেকে নতুন কারিকুলামে থাকছে না প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণী পরীক্ষা এমনটাই জানা গেছে। প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের এই কয়েক বছর জিপিএ’র প্রতি কি পরিমাণ ছোটাছুটি করতে হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
কি বিপুল চাপে তাদের সারাক্ষণ পড়তে বসতে হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল,কোচিং আর প্রাইভেট নিয়ে থাকতে হয়েছে। সেসব করতে গিয়ে তাদের খেলাধূলা করা হয়নি। সবসময় চাপ আর চাপ। অভিভাবকরাও ছুটেছে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজে।
অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠান থেকে তার সন্তান জিপিএ ফাইভ পেতে পারে। যেভাবেই হোক জিপিএ ফাইভ তার চাই। এই হলো অবস্থা! সেটা জেএসসিতেও এবং বাকি সব পাবলিক পরীক্ষাতেও। কিন্তু ঐ ছোট্ট বয়সেই যে চাপ তার মনের ওপর গেছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! অনেকে খেলতেই ভুলে গেছে!
অথচ সক্রেটিস এরিষ্টোল প্লেটোর হাত ধরে যে শুদ্ধ শিক্ষার ইতিহাস বয়ে চলেছে তার বিপরীত ব্যাবহারের ফল যে আমাদের এমন বেহাল দশা করে ছাড়বে তা কে জানতো। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না তার কোন প্রয়োজন নেই। আজকাল যেন সেই মূল লক্ষ কেবল সার্টিফিকেট। সেটা লেখাপড়া করে হোক বা টাকা দিয়ে কিনে হোক কার্যসিদ্ধি হলেই হলো। কোনমতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ।
তারপর এদিক সেদিক ধরাধরি করে একটা চাকরি বাগিয়ে সমাজে দিব্বি মেধাবী সেজে ঘুরে বেড়ানো যায়। একসময় দেশে পরীক্ষায় নকল করার একটা প্রবণতা ছিল। তখন পাসের হারও কম ছিল। কিন্তু সবাই নকল করতে পারতো না। তবে আশ্চর্যের বিষয় কিন্তু সেটা নয়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো সেসময় পরীক্ষার কেন্দ্রে অসুদপায় অবলম্বন করলেও শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না। কে পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল করেছে সে বিষয়টার স্বাক্ষী কেবল আরেক পরীক্ষার্থী থেকে যেত। আজ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকে নকলমুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র।
তবে শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন? দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজন। পাসের হার বৃদ্ধি করে আপাত শিক্ষার প্রসার হলেও মান না বাড়লে স্থায়ী ক্ষতি হয়। শিক্ষার বাণিজ্যিকিরণ আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মারাত্বক। শিক্ষা যদি কোন ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে না পারে তাহলে ধরে নিতে হবে সেই শিক্ষা কেবল বিষ ঢেলেছে অমৃত নয়।
আজ যারা বড় বড় পদে থেকেও বড় বড় চুরি করছে তারাও তো শিক্ষিত। তাহলে এই অন্যায় তারা করছে কিভাবে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ তারা শিক্ষা অর্জন করলেও তা সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যেই সিমাবদ্ধ রয়ে গেছে। আর তাই শিক্ষা বিষয়টা আজ এতটা প্রশ্নবিদ্ধ।
বেসরকারি মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ কারণেই অভিভাবকদের একটি অংশের আগ্রহে থাকে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিত্তশালী মানুষের সাথে সাথে সাধারণ আয়ের পরিবারের সন্তানেরাও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া করে শুধুমাত্র ভালো লেখাপড়া, উন্নত মান এবং ভালো ফলাফলের আশায়।
কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি ও অন্যান্য ফি আদায় অনেক বেশি হওয়ায় অভিভাবকদের জন্য মানসিক চাপের কারণ হয়। যদি একটি নিয়মের মধ্যে আসে অর্থাৎ নির্ধারিত ফি এর আওতায় আসে তখন এই চাপ কমবে।
লেখক-
শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক