সব শিশুর জন্য চাই আনন্দপাঠ
সাধারণভাবে আমাদের দেশে শিক্ষার মান খুব নিন্ম পর্যায়ে। মাস্টার্স পাস করা একজন শিক্ষার্থীর যেটুকু বিদ্যাবুদ্ধি থাকার কথা বেশির ভাগের তা থাকে না। যুক্তির শৃঙ্খলা, পাঠের আগ্রহ, নিষ্ঠা, সততা- এসবও থাকে ন্যূনতম পর্যায়ে। ফলে জাতীয় জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে অদক্ষতা, অযোগ্যতা, অসততার কালো থাবার বিস্তার ঘটেনি।
পরিস্থিতির উন্নয়নের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। বরং সম্প্রতি শিক্ষা খাতে কারিকুলাম, পাঠদান, পরীক্ষাপদ্ধতি, প্রশ্ন প্রণয়নসহ একের পর এক যে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে তার লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
এগুলো শিক্ষার উন্নয়নে করা হচ্ছে নাকি জাতিকে জ্ঞানগতভাবে দুর্বল করে রাখার সুদূরপ্রসারী কার্যক্রম। এর সথে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের অপতৎপরতা।
বিষয়টি এরই মধ্যে সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও সরকার বা সুশীলসমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহল কোনো দিক থেকে প্রতিকারের কোনো আহ্বান পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, সবাই মেনে নিয়েছেন, এভাবে চলবে। এর মধ্যে আমাদের বসবাস করতে হবে।
এই সর্বময় হতাশার চালচিত্রেও মাঝেমধ্যে দুয়েকটি শুভ উদ্যোগ চোখে পড়ে না তা নয়। এমন একটি শুভ উদ্যোগ, এসো একসাথে পড়ি বা ‘লেট আস রিড টুগেদার’। এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহায়তায় জাগো ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ এটি।
এই প্রকল্পের লক্ষ্য দেশের পাঁচটি জেলার শিশুদের জন্য ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার, শিশুর ইন্টারনেট ব্যবহারের পুরো সময় যেন ফলপ্রসূ হয় সেটি নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল শিক্ষা প্রচার।
আমরা জানি, এশিয়া ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্প আছে যেখানে বিভিন্ন দেশের লাইব্রেরিতে বই সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় রঙিন ছবির বই প্রকাশও করে।
বাংলাদেশে শিশুদের জন্য বিনামূল্যের ডিজিটাল গল্পের বইয়ের গ্রন্থাগার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সে কথাই বলেছেন এক অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, এশিয়ার অনেক শিশু রঙিন, আকর্ষণীয় গল্পের বই পায় না। যে বই শিশুকে পড়তে ও শিখতে আগ্রহী করে তুলবে, অনুপ্রেরণা দেবে এমন বই তাদের নাগালের বাইরে।
বাংলাদেশের শিশুদের জন্য কথাটি সত্যি। খুব ভালো এবং আকর্ষণীয় শিশুতোষ বই আমাদের নেই। যা আছে সেগুলো ইংরেজিতে। ইন্টারনেটেও তাই।
বাংলাভাষী একটি শিশু মুখে বুলি ফোটার সাথে সাথে ইংরেজিতে ছড়া কাটবে, গল্প বলবে, ভাবতে শিখবে, কল্পনা করবে, এটিই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে ভাষা আন্দোলনের কী দরকার ছিল?
মূল কথা হলো, বাংলায় সব শিক্ষা উপকরণ তৈরি করতে হবে এবং তা হতে হবে বিশ্বমানের। সে উদ্যোগ এখনি নেয়া দরকার।
জাগো ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এর আবেদন সীমিত। আমাদের দরকার দেশের সব শিশুকে নিয়ে ভাবা। বিদেশে একটি কার্যক্রম আছে, একই নামে। এর লক্ষ্য ভিন্ন।
সেটি হলো, পরিবারে ও স্কুলে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকের বা শিক্ষকের বৃন্দপাঠ। এ নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের সময়টি হলো শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আর শিশুদের সাথে নিয়ে পড়া প্রাথমিক সাক্ষরতায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
এ সময় অভিভাবক যদি শিশুকে সাথে নিয়ে আকর্ষণীয় ছড়ার বই বা গল্পের বই বাছাই করেন, তাকে পড়ে শোনান, পঠিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন, ক্ষেত্রবিশেষে মজা করেন বা অভিনয় করে বিষয়টি উপস্থাপন করেন তাহলে শিশুর মনে সেটি গেঁথে যায়।
সে পড়ার কাজটিকে বোঝা মনে করে না; বরং তার পাঠের আগ্রহ বাড়ে। এটিই হলো শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা। আমাদের সবার আগে দরকার এই কাজ। ইদানীং স্কুলে আনন্দময় পাঠপদ্ধতির কথা খুব শোনা যায়।
কিন্তু সে কেবল রাজধানীর নামীদামি স্কুলগুলোতে, যেখানে সচরাচর সচ্ছল পরিবারের শিশুরা পড়তে যায়। আমরা দেশের সব শিশুর জন্য আনন্দপাঠের আয়োজন চাই।