নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন
অনলাইন ডেস্ক।।
গোলাম রব্বানী বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভাইভা দিয়েছি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফল হয়েছে। ধারণা করেছিলাম, তিন-চার মাসের মধ্যে নিয়োগ হয়ে যাবে। নিয়োগের আশায় কোনো প্রাইভেট কোম্পানিতেও চাকরি নেইনি। বাবা অবসরে যাওয়ার পর যে টাকা পেয়েছি, তা দিয়ে বোনদের বিয়ে ও দুই ভাইকে বাড়ি করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা আছেন। একটি মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। সাত-আট বছর আগে অবসরে গেছেন। বাবার হাতে এখন কোনো টাকাই নেই। জমি সব বন্ধক আছে। এর মধ্যে কিছু বিক্রিও করতে হয়েছে। ২২ মাসের সন্তানকে নিয়েও মহাবিপদে আছি। তার পেছনে প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এ টাকা কই পাই? কি যে কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছি, সেটা বলে বুঝানো যাবে না। ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। কোনো দিকে যখন কূল কিনারা করতে পারছিলাম না, তখন বাধ্য হয়ে ২৮-২৯ দিন হলো কঠোর পরিশ্রমের কাজ শুরু করেছি।
আরেক নিয়োগ প্রত্যাশী মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার আবদুর রহিম। তার দুই ছেলে ফাহিম ও আয়ান। ফাহিমের বয়স ১২ বছর আর আয়ানের চার। ফাহিম তিন বছর ধরে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। রাজধানীর মহাখালীর একটি হাসপাতালে চলছে তার চিকিৎসা। তার পেছনে প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে বড় অংকের টাকা। ১৪তম নিবন্ধনে সুপারিশপ্রাপ্ত তিনি। কিন্তু নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতায় বেহাল দশা তার।
আবদুর রহিম বলেন, ঘর থেকে বের হতে পারি না। সবাই হাসাহাসি করে। বলে যে, নিয়োগের সুপারিশ পাওয়ার পরও কেন কাজে যোগদান করছি না। আসলেই কি সুপারিশ পেয়েছি কিনা এটা তাদের সন্দেহ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে পাস করে বের হয়েছেন বাগমারা উপজেলার নাজমুল সরদার। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাকি দুই ভাইয়ের একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আরেকজন এবার ক্লাস নাইনে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা অপারেশনের পর গত ছয় মাস ধরে শয্যাশায়ী। সুপারিশের পর নিয়োগের আশায় থাকতে থাকতে শেষমেশ বাধ্য হয়ে নিজ এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ বেছে নিয়েছেন তিনি।
সিলেটের সদর উপজেলার শাহী ইদগাহ এলাকার বাসিন্দা শারমিন জাহান তন্নী। শিক্ষকতা তার পছন্দের পেশা। এজন্যই এই পেশাকে বেছে নিতে চেয়েছেন। ধীরে ধীরে স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন। ১৫তম নিবন্ধনে সুপারিশপ্রাপ্তও হয়েছেন। কিন্তু তার স্বপ্ন এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে আছি যে, ঘর থেকে বের হতে পারিনা। সবাই জিজ্ঞেস করে কবে কাজে যোগ দেব। তাদেরও দোষ নেই, তারা তো ছয় মাস আগে শুনেছে আমি নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে হতাশায় প্রার্থীরা
রব্বানী, রহিম, নাজমুল আর তন্নীর মতো বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক নিয়োগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন ৩৮ হাজার প্রার্থী। প্রাথমিকভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রায় ছয় মাস কেটে গেলেও পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে।
এনটিআরসিএ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত শূন্যপদ ধরে গত ৩০ মার্চ তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে ৫৪ হাজার ৩০৪টি পদ ফাঁকা ছিল। ১৫ জুলাই তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশ করা হয়। তবে ৫১ হাজার ৭৬১টি পদে সুপারিশের কথা থাকলেও ৩৮ হাজার ২৮৬ জন প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়েছে।
এনটিআরসিএ বলছে, নিয়োগের সুপারিশ পাওয়া সবার পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়নি। এই কাজ শেষ হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে।
তিনি বলেন, নতুন সচিব আসার পর আমাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল। তবে এখনও সেটা হয়নি। এই সপ্তাহে বা আগামী সপ্তাহে বসতে পারে। তখন আমরা বিস্তারিত জানাব। সেখান থেকে আপডেট পাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরসহ বিভিন্ন পদে আগাম ভেরিফিকেশন ছাড়াও অনেক নিয়োগ সম্পন্ন করেছে দফতরটি। তাদের প্রশ্ন পুরোপুরি সরকারি নিয়োগে ভেরিফিকেশন ছাড়াই নিয়োগ হচ্ছে। অথচ আমাদের কেন ভেরিফিকেশন ছাড়া নিয়োগ হচ্ছে না। অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শূন্যপদ থাকায় প্রতিষ্ঠান খোলার পরও পাঠদানের ধারাবাহিকতা রক্ষা ব্যাহত হচ্ছে।
আরেক নিয়োগপ্রত্যাশী আমিনুল ইসলাম অনন্ত বলেন, মুজিববর্ষে ৩৮ হাজার শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে পারতো। কিন্তু তারা তাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও এনটিআরসিএর সদিচ্ছা ছিল বলেও মনে হয় না।