নির্দেশনার বেড়াজালে জর্জরিত সরকারিকৃত কলেজগুলো
নিজস্ব প্রতিবেদক:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিটি উপজেলায় একটি করে হাইস্কুল ও একটি করে কলেজ সরকারিকরণের কাজ আরম্ভ হয় ২০১৬ সালে। প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট সারাদেশের ২৭১টি কলেজকে একসঙ্গে জিও (Government Order) জারির মাধ্যমে একই সনের ৮ আগস্ট থেকে কলেজগুলো সরকারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সরকারি নির্দেশনা অনুসারে ওইদিন থেকেই কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার কথা। পর্যায়ক্রমে এ তালিকায় আরো কলেজ যোগ হচ্ছে।
জিও জারির পর ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট এক আদেশ জারির মাধ্যমে কলেজগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করা হয়। আদেশে উল্লেখ করা হয়, “সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ এর আলোকে ইতোমধ্যে ২৭১টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে বিধায় সরকারিকৃত কলেজের পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম বিলুপ্ত হয়েছে”। কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণের কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আর্থিক বিষয়সহ অন্যান্য কার্যাদি সম্পাদনের জন্য জেলা শহরে অবস্থিত কলেজগুলোর ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে অবস্থিত কলেজগুলোর ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যৌথ স্বাক্ষরে সম্পাদন হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর ঠিক তিন বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গত ২ জানুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) ফাহিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সরকারিকৃত কলেজগুলোতে গভর্নিং বডি গঠনের লক্ষ্যে এডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯২ সনের ৩৭ নং আইন'-এ ধারা ৪০ উপধারা (২) -এ উল্লেখ রয়েছে, "প্রত্যেক কলেজ একটি গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত হইবে এবং উক্ত গভর্নিং বডির গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সংবিধি দ্বারা নির্ধারিত হইবে"।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, ১২/০৮/২০১৮ এর তালিকা এবং তার পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত যে সকল কলেজ সরকারিকরণ হয়েছে সে সকল কলেজ এর গভর্নিং বডি গঠন সংক্রান্ত (সংশোধিত) সংবিধি ২০১৯ এর ধারা ৪ (ক) মোতাবেক "প্রত্যেক অধিভুক্ত কলেজ (সরকারি ও বেসরকারি) নিয়মিতভাবে গঠিত একটি গভর্নিং বডি দ্বারা পরিচালিত হইবে।" নতুন এ নির্দেশনায় বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কলেজের প্রশাসন। এ নির্দেশনায় সারা বাংলাদেশের সরকারিকৃত কলেজের শিক্ষকরা বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। অধ্যক্ষরা কি করবেন তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। আবার অনেক লোকাল নেতারা কোনো কোনো কলেজে যেয়ে এডহক কমিটি গঠন করছেন কিনা অধ্যক্ষদের কাছে জানতে চাচ্ছেন। এসব ধুম্রজালে বিপাকে অধ্যক্ষরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা জানান, "আগের কমিটি বিলুপ্ত হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুসারে এখন কলেজগুলোতে কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির তালিকা আমাদের হাতে আসলে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী আদেশ জারি করব। এ ব্যাপারে বিভ্রান্তির কিছু দেখছি না"।
শিক্ষকরা মনে করছেন সরকারিকৃত কলেজগুলোকে চাপের মুখে রাখতেই সংবিধিতে এ নতুন সংযোজন! না-হয় তিন বছর পরে এ সিদ্ধান্ত কেন? তাছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, ২০১৮ সালে কলেজ সরকারিকরণের পর ২০১৯ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি সংশোধন করে সরকারিকৃত কলেজগুলোকে এ তালিকায় ইচ্ছে করেই রাখা হয়েছে। এটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশও হতে পারে।
এদিকে সরকারিকৃত তিন শতাধিক কলেজ থেকে দীর্ঘ ৬ বছর শেষে মাত্র ১টি কলেজের নিয়োগ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রথমে নিজ প্রতিষ্ঠানে, তারপর মাউশিতে এবং সবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনবার যাচাই-বাছাই করতেই শেষ হয়েছে প্রায় ছয় বছর। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পদ সৃজনের কাজ চলমান থাকলেও গতি খুবই কম। বেশ কয়েকটি কলেজের ফাইল প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির মিটিং এ উত্থাপনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যেগুলোর মতামত চাওয়া হয়েছে সেগুলো সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত উঠছে না। আবার মতামত চাওয়া ফাইলগুলোর কাজও দীর্ঘ তিন-চার মাসে শেষ হচ্ছে না। তবে অতি সম্প্রতি গত ২ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক আবেদনে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় একটি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে না করে একবারে প্রস্তাব করার পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত শিথিলকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে করে আগেরগুলো আগেই উত্থাপিত হবে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কলেজগুলোতে আত্তীকরণের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় শিক্ষক-করমচারী নিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা চলমান রয়েছে। আবার কলেজেগুলোর একটি বৃহৎ অংকের শিক্ষক অবসরে যাওয়ার কারণে পাঠদান কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। একদিকে শিক্ষক-কর্মচারী খালি হচ্ছে অন্যদিকে নিয়োগ বন্ধ। বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। আবার সরকারি কলেজের সাইনবোর্ড দেখে ভর্তি হয়ে বেসরকারি নিয়মে বেতন ও ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে তাদের। অনেকেই মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের সরকারি বেতন চালু হলে বেশিরভাগ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের কলেজ প্রদত্ত বেতন-ভাতা বন্ধ হবে। তখন তারা আন্দোলনে যেতে পারে এবং এ আন্দোলনের প্রেসার কর্মকর্তাদের উপর পড়তে পারে এই শংকা থেকেই হয়তো জামেলা এড়িয়ে চলছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কলেজগুলোর জিও জারির পর প্রায় চার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে গেছেন। এমনকি প্রতিদিনই কেউ না কেউ অবসরে যাচ্ছেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে তাদের সবাইকে ভূতাপেক্ষ নিয়োগ দিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা হবে মৌখিকভাবে বলা হলেও আত্তীকরণ বিধিমালায় কোনো সংশোধনী এখন পর্যন্ত আনা হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো পরিপত্রও জারি হয়নি। মুখের কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না বলে জানাচ্ছেন শিক্ষকরা। ‘আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ এর ধারা ৮-এ উল্লেখ আছে “সরকারিকৃত কলেজের কোন শিক্ষক তা যে পদেরই হোক না কেন, ক্যাডারভূক্তির জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে প্রভাষক পদে ক্যাডার ভূক্তি হতে পারবেন”। কাগজে-কলমে এ বিধি থাকলেও আজ পর্যন্ত কমিশন কর্তৃক কোনো নির্দেশনা বা নীতিমালা প্রকাশ করা হয়নি। আত্তীকরণ শুরু হলেও এ ব্যাপারে উদ্যোগ দেখছেন না বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।
এদিকে নতুন এমপিও নীতিমালা অনুসারে ডিগ্রি কলেজের মোট শিক্ষকের ৫০ শতাংশ সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির বিধান এবং ১০ বছর পর শিক্ষকরা পরবর্তী গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ পেলেও সরকারিকৃত কলেজের শিক্ষকদের সরকারিকরণের নামে আটকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ৭ম গ্রেডের শিক্ষকদের ৯ম গ্রেডে এবং লাইব্রেরিয়ান ও সহকারী লাইব্রেরিয়ানদের বর্তমান গ্রেডের পরিবর্তে নিচের গ্রেডে নিয়োগ দেওয়ারও বিস্তর অভিযোগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের। সবমিলিয়ে সরকারিকৃত কলেজগুলো আছে বেহাল দশায়। এডহক কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি (সকস্বাশিস) এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. শরীফ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্তে আমরা বিব্রত। যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করেছে সেখানে তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরণের সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের একটি চিঠি প্রকাশের আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার ছিল। আমরা আগে আমাদের নিয়োগ চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ মহৎ উদ্যোগ শতভাগ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে শিক্ষক-কর্মচারীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে এডহক নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হলে অন্যান্য সরকারি কলেজ যে নিয়মে পরিচালিত হয় সরকারিকৃত কলেজগুলো সেভাবে পরিচালিত হতে আর কোনো বাধা থাকবে না এবং যাবতীয় সমস্যা সমাধানের রাস্তা সহজেই বের হবে।