এমপিও নীতিমালা-২০১৮: সমস্যার সমাধান নাকি সৃষ্টি
মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক।।
বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ প্রণয়ন দেশের শিক্ষাঙ্গনের উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ণে একটা বড় সাফল্য। সুদীর্ঘ ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালের পর শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন উন্নয়ন সাধন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের ঐকান্তিক সদ্বিচ্ছায় ১৮ জুন, ২০১৮ সালে এটি প্রণয়ন করা হয়। পরে এর বিভিন্ন সমস্যা ও শিক্ষক-কর্মচারির দাবির প্রেক্ষিতে ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ এ এটি সংশোধণ করে চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশ করা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু পদের নিয়োগ কার্যক্রমও শুরু হয়। তবে এর বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু বৈষম্য ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মচারিসহ বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত প্রচেষ্ঠায় নীতিমালাটি আবার সংশোধণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, শিক্ষামন্ত্রীর অংশগ্রহণের মাধম্যে কয়েকদফা মিটিংয়ের পর গত ২৩ নভেম্বর-২০২০ এ নীতিমালাটির মাদ্রাসা অংশটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়।
তবে মাদ্রাসা নীতিমালাটি সংশ্লিষ্ট একটা শ্রেণিকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হলেও এর দ্বারা একাধিক পক্ষের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। শিক্ষাক্ষেত্রে সমমান কথাটা অগ্রাধিকার পেলেও এ নীতিমালাটি জেনারেল শিক্ষিত শিক্ষক-কর্মচারি-শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। নীতিমালাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের যোগ্যতাকে একচ্ছত্রভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নীতিমালায় বিদ্যমান মাদ্ররাসা শিক্ষা ও জেনারেল শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু স্পষ্ট বৈষম্য নিচে তুলে ধরা হলো---
১. মাদ্রাসা সকল স্তরের প্রধান পদে(এবতেদায়ি প্রধান, সুপারিন্টেনডেন্ট, সহকারী সুপারিন্টেনডেন্ট, অধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যক্ষ- ক্রমিক নং- ১,২,৬,৭,৯,১০,১৬,১৭,৩১) জেনারেল শিক্ষিতদের নিয়োগের সুযোগ না রাখা এবং শিক্ষক-প্রভাষকগনের পদোন্নতির সুযোগ না রাখা। উচ্চ পদস্থ এই ৯টি প্রশাসনিক পদে শুধু আরবি ভাষা শিক্ষা রিলেটেড যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বের ক্ষেত্রে কোনো একক বিষয়ের যোগ্যতার সম্পর্ক নেই।
২. আলিম পাশ এবতেদায়ি মৌলবি(ক্রমিক নং-৩২) শুধু ৮ বছরের অভিজ্ঞতার দ্বারা এবতেদায়ি প্রধান(ক্রমিক নং-৩১) হতে পারবেন, আবার ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা দ্বারা সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট(ক্রমিক নং-১৭) হতে পারবেন। পরে ৩ বছরের অভিজ্ঞতায় আবার সুপারিনটেনডেন্টও হতে পারবেন। একই ভাবে সুপারিনটেনডেন্টগণ আমিল এবং পর্যায়ক্রমে ফাজিল-কামিলের উপাধ্যক্ষ- অধ্যক্ষ হবার সুযোগ পাবেন, অথচ একই পর্যায়ের জেনারেল শিক্ষক, প্রভাষকগণ অনার্স-মাস্টার্স পাশ হয়ে এবং জ্যেষ্ঠ প্রভাষক- সহকারী অধ্যাপক হয়েও কোনো পর্যায়েই সহকারী অধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষ হবার সুযোগ পাবেন না। এরূপ বৈষম্য সত্যিই হাস্যকর, লজ্জাজনক। মাদ্রাসা মানে কি শুধু মাদ্রাসা শিক্ষিতরাই সকল সুবিধা ভোগ করবেন? আর জেনারেলরা প্রতিষ্ঠানের করুনার দান বলে বিবেচিত হবেন?
৩.সহকারী সুপারিন্টেনডেন্ট, সুপারিন্টেনডেন্ট, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ পদগুলোর নিয়োগে শুধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত শুধু কুরআন, হাদিস রিলেটেড সাবজেক্ট এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু আরবি সাবজেক্টকে যোগ্যতা হিসেবে গন্য করা হয়েছে, অথচ দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগ গুলোও আরবি শিক্ষা বা মাদ্রাসা শিক্ষার সহযোগী বিভাগ, এই বিভাগগুলোতে সাধারণত মাদ্রাসা হতে দাখিল-আলিম পাশকৃত শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করেন, তাদেরকেও উপরের উল্লিখিত পদগুলোসহ আরো কিছু পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
৪.ফাজিল-কামিল মাদ্রাসায় গ্রন্থাগারিক পদের(ক্রমিক নং-১৫) যোগ্যতায় বৈষম্য ও সঠিক যোগ্যতার অবমূল্যায়ন হয়েছে-
বৈষম্যঃ গ্রন্থাগারিক পদটি নন-টিচিং ও টেকনিক্যাল পদ, এর যোগ্যতা হবে সমমান, অথচ শুধু মাদ্রাসা শিক্ষিত কামিল পাশ এবং আরবি বিষয়ের মাস্টার্সধারীদের জন্য পদটি সংরক্ষিত করা হয়েছে।
সঠিক যোগ্যতার অবমূল্যায়নঃ গ্রন্থাগারিক পদটি উচ্চতর পদ, এর যোগ্যতা হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অর্থাৎ গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ। অথচ এখানে শুধু ডিপ্লোমা পাশ যোগ্যতা রাখা হয়েছে। ডিপ্লোমা ডিগ্রির দ্বারা দেশের আর কোনো ক্ষেত্রেই গ্রন্থাগারিক হবার সুযোগ নেই। এর জন্য গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি বাধ্যতামূলক।
৫. সহকারী গ্রন্থাগারিক ( ক্রমিক নং-৩৫) পদে যোগ্যতা বৈষম্যঃ নন-টিচিং ও টেকনিক্যাল পদ হওয়ার সত্বেও সমমান না রেখে সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে শুধু ফাজিল পাশ ও আরবি বিষয়ে অনার্স পাশদের জন্য পদটি সংরক্ষণ করা হয়েছে।
মাদ্রাসা গ্রন্থাগারে আরবি বিষয়ের কিছু বইয়ের আধিক্য থাকাটাই স্বাভাবিক, তাই আরবি পারদর্শিতার শর্তে গ্রন্থাগারিক ও সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে সমমান রাখা যেত কিন্তু জেনারেল শিক্ষিতদের পদ দুটি থেকে একেবারে বঞ্চিত করা হয়েছে।
৭.অফিস সহকারী কাম হিসাব সহকারী পদটি দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যবসায় শিক্ষায় কমপক্ষে এইচএসসি পাশকৃতদের জন্য সংরক্ষিত থাকে, কিন্তু পদটি সমমান দিয়ে এর প্রকৃত যোগ্যতাকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। পদটি এইচএসসি/আলিম সমমান কখনই হতে পারে না। কারণ পদটির সাথে হিসাববিজ্ঞান শাস্ত্রের বিভিন্ন নিয়ম-কানুনের প্রয়োগ জরিত, যা একজন ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা অর্জন করে থাকে, অপর দিকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু এসএসসি পর্যন্ত গণিত বিষয়টি আবশ্যিক ভাবে শিখানো হয় তাহলে এইচএসসি/সমমান পর্যায়ের মানবিক বা কিছু কারিগরি শাখার শিক্ষার্থীরা কিভাবে হিসাব সংক্রান্ত পদটিতে সমমান পাবে? তারা তো এইচএসসিতে কোনো গণিতই অধ্যয়ণ করেন নি।
৮.অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরে সমমান উল্লেখ থাকলেও একটা অস্পষ্ট শর্ত জেনারেল শিক্ষিত কম্পিউটার প্রশিক্ষিতদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় আরবি কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে এটাই স্বাভাবিক, যা আরবি বর্ণ ও ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা যেকোনো কম্পিউটার অপারেটর আরবি ভাষার কী-ওয়ার্ড ব্যবহার করে লিখতে পারবেন, বর্তমানে অনেক সহজ আরবি কী-ওয়ার্ড পাওয়া যায়। তবে শর্তে বলা হয়েছে "আরবি কম্পিউটার অপারেটিং এ আবশ্যিক ভাবে নির্ধারিত দক্ষতা থাকতে হবে।" আবশ্যিক নির্ধারিত দক্ষতার অজুহাতে শুধু মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার এটা একটা পরিকল্পিত কৌশল নয়তো?
৯. বাংলা, ইংরেজি, আরবির মত গণিত অপরিহার্য বিষয় হওয়ার পরও আলিম পর্যায়ে "গণিত প্রভাষক" পদটির অনুপস্থিতি।
উপর্যুক্ত আলোচিত বিষয়গুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নীতিমালাটি দ্বারা মাদ্রাসা শিক্ষিত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারি-শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা ও অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে অপরদিকে জেনারেল শিক্ষিত শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থীদের হেয় এবং বঞ্চিত করা হয়েছে। যা তাদের জন্য চরম অপমানের ও হতাশার।
নীতিমালার এই সংশোধণী দ্বারা সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। তাই আমি একজন জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত চাকুরি প্রার্থী হয়ে, দেশের সকল জেনারেল শিক্ষিতদের পক্ষ থেকে সংশোধিত নীতিমালা-২০১৮(২৩-নভেেম্বর-২০২০ পর্যন্ত) প্রত্যাখ্যান করছি এবং অতিসত্বর জেনারেল প্রতিনিধির অংশগ্রহণে নীতিমালাটির পুনঃ সংশোধণ দাবি করছি।