কেমন ছিল ২০২০ সালটি
ড. আর এম দেবনাথ।।
ব্যবসায়, বাণিজ্য ও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২১ সালটি কেমন হবে? এর আগের প্রশ্ন—কেমন গেল ২০২০ সাল। এর হিসাব দুইভাবে। সরকারের দুই আর্থিক বছর পড়েছে ২০২০ সালে। আবার এটি ব্যাংকারদের ‘অ্যাকাউন্টিং ইয়ার’ হিসাবের বছর। সরকারি হিসাবের দিকে গেলে বলতে হয় ২০২০ সালটি ছিল মিশ্র। জনজীবনে দারুণ অনিশ্চয়তা থাকলেও করোনা-১৯ এর তাণ্ডব থাকলেও ২০১৯-২০ সালটি গেছে প্রবৃদ্ধির ভেতর।
এই সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। প্রতিবেশী দেশ যখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির শিকার, যখন বিশ্ব অর্থনীতি ‘করোনা-১৯’-এ আক্রান্ত এবং মন্দার শিকার তখন ৫ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম কি? এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাবে এর প্রথম ছয় মাস চলে যাচ্ছে। ৩১ ডিসেম্বর হচ্ছে ছয় মাসের শেষ। সামনে ইংরেজি নববর্ষ। ব্যাংকারদের নববর্ষ। কেমন যাচ্ছে তাহলে প্রথম ছয় মাস। বোঝাই যাচ্ছে—অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য মোটামুটি স্থিতিশীল।
আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, খাদ্যশস্য উত্পাদন, রাজস্ব মূল্য, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বড় বড় সূচকের নিরিখে বলা যায়—বছরটি শেষ হচ্ছে স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে। বরং বেশ কিছুটা স্বস্তির খবরের মধ্যে। স্বস্তির খবরের মধ্যে আছে—মূল্যস্ফীতির খরব।
মূল্যস্ফীতি নভেম্বরের দিকে কিছু হ্রাস পেয়েছে। গেল অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ। এটি হ্রাস পেয়ে নভেম্বরে নেমেছে সাড়ে ৫ শতাংশে। বড় খবর সাধারণ মানুষ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং অবসরপ্রাপ্তদের জন্য। যে কারণে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে তা হচ্ছে—সবজির দামে নিম্নগতি।
বাজার এখন শীতের শাকসবজিতে সয়লাব। মাসখানেক এই বাজারে ছিল আগুন। একের পর এক বন্যায় শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। বেড়েছে তাই সবজির দাম। এই মুহূর্তে শাকসবজির দাম যেমন কম, তেমনি কিছুটা নিচের দিকে স্থিতিশীল মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের দাম।
এখন খেয়ে পরে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে, যদিও করোনার কারণে শহরের লোক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং তাদের মধ্যে দারিদ্র্য বেড়েছে। অগণিত মানুষ হয়েছে বেকার, চাকরিচ্যুত, ব্যবসাচ্যুত। তবে এরই মধ্যে ভালো খবর রেমিট্যান্স প্রাপকদের। সারা দেশের ‘রেমিট্যান্স অঞ্চলগুলোর’ মানুষ সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
প্রায় ১ কোটি পরিবারের এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে। জুলাই-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে ৪২ শতাংশ বেড়েছে রেমিট্যান্স। এই ডলার দেশে এসেছে। তা ‘ক্যাশে’ রূপান্তরিত হয়েছে, গেছে গ্রামে।
গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অভাব-অনটন কেটেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ‘ক্যাশের’ অভাব ঘটেনি। গ্রামাঞ্চলে আবার মহামারি ‘করোনা-১৯’-এর আক্রমণ কম। রোদেপোড়া সাধারণ কৃষকের ‘ইম্যুনিটি’ বেশি বলে মনে হয়। এ কারণে তারা গ্রামের অর্থনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্যকে মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছে। খাদ্যশস্য উত্পাদন বিঘ্নিত হয়নি। বছরের শুরুতে বোরো উত্পাদন ভালো হয়েছে। আবার অগ্রহায়ণী ফসলও (আমন) ভালো হয়েছে। এটি কৃষকদের অবদান।
ফলে এই সংকটের মধ্যেও চালের দাম ছিল স্থিতিশীল, যদিও এই মুহূর্তে এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ধান-চালের দামে ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্ধিত পরিমাণ রেমিট্যান্স আরেক কাণ্ড ঘটিয়েছে। ব্যাংকিং খাত এখন তারল্যে (লিক্যুইডিটি) ভাসছে। টাকা, শুধুই টাকা। ঋণগ্রহীতা, নতুন ঋণগ্রহীতা নেই। ব্যাংকগুলো ব্যস্ত পুরোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের চাহিদা মেটাতে।
সরকার তাদের জন্য লক্ষাধিক কোটি টাকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে ব্যাংকগুলো এখনো ব্যস্ত সেই টাকা বিতরণে (ডিসবার্সমেন্ট)। কঠিন কাজ। অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল টাকা ‘ডিসবার্সমেন্টের’ কাজ। এমন হলে অনিয়ম হয়, দুর্নীতি হয়। এমনিতে ব্যাংকগুলোর অবস্থা শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণের ভারে জর্জরিত। এর ওপরে তাড়াহুড়া করে বড় বড় ঋণ বিতরণ।
তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণখেলাপিদের মধ্যে। পরিণতি কী হবে—তা কেউ জানে না। এই পরিস্থিতিতেই তারল্যের বন্যা। ঋণ নেওয়ার নতুন লোক নেই। বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থা ২০২০ সালে ছিল এক জায়গায়।
তা গত ১০ বছর যাবত্। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে এই ক্ষেত্রে ১৪-১৫শতাংশ বৃদ্ধি। তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। এদিকে রপ্তানি বাজার আলচ্য সালে ছিল মোটামুটি স্থিতিশীল। ইউরোপ ও আমেরিকা আমাদের পোশাক পণ্যের বড় বাজার। অথচ তাদের দেশগুলো করোনা আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। এমতাবস্থায় আশঙ্কা ছিল আমাদের পোশাক রপ্তানিতে ধস নামবে। না, তা হয়নি।
কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে কিন্তু পোশাক রপ্তানি জুলাই-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে গেল বছরের তুলনায় এক-দুই শতাংশ বেড়েছে। কম কি? এই পাঁচ মাসে রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার। আমদানি অবশ্য কম। বলা যায়, সব ধরনের পণ্যের আমদানিই কম।
শিল্পপণ্য, মধ্যবর্তীপণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি—এমনকি ভোগ্যপণ্যের আমদানিও কম। আবার আমাদের অন্যতম আমদানি পণ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে আমদানি ব্যয় বেশ কিছুটা কমেছে। এসবের ফল কী? রপ্তানি স্থিতিশীল নয়, বরং কিছুটা বৃদ্ধি, রেমিন্ট্যাস ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি, আবার উলটো দিকে আমদানির পরিমাণ কম।
এর ফল কী? ফল হচ্ছে—বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধি। রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে নতুন এক উচ্চতায়। কয়েক দিন আগেই তা ছিল ৪২ বিলিয়ন (বিলিয়ন সমান শতকোটি) ডলার। ডিসেম্বর শেষে তা আরো বাড়বে বলে বিশ্বাস।
রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভই জন্ম দিয়েছে ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্যকে। এর আবার কুফলও আছে। বেশি টাকা হাতে থাকা সব সময় ভালো লক্ষণ নয়। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের কিছুটা অংশ থাকে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য। বিদেশি অনেকে বাংলাদেশে কাজ করে। বিদেশি অনেক কোম্পানি আছে, আবার সরকারকে শোধ করতে হয় বিদেশি ঋণের টাকা।
এর জন্য একটা অংশ খরচ হয়। এখন এসব খরচ কম। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ। বলা হয়—বেশি বেশি রিজার্ভ হলে তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থাকে। আমাদের মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার সাড়ে ৫ শতাংশ। তা সহ্যসীমার মধ্যে। বলা যায় না, রিজার্ভ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীকে ২০২১ সালে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
এদিকে সরকারের রাজস্ব পরিস্থিতিও স্থিতিশীল। রাজস্ব নির্ভর করে ‘জিডিপি’র ওপর। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ঘটলে রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে দেখা যাচ্ছে, সরকারের রাজস্ব গেল বছরের তুলনায় সামান্য কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য তা লক্ষ্যমাত্রানুযায়ী কিছুই নয়। এর অর্থ—গেল বছরের অর্থনীতির স্তর ঠিকই রয়েছে।
যে মাত্রায় গেল বছর অর্থনীতি চলছিল এবারও তাই আছে। এর ফলে সরকার তার খরচের জন্য কোনো চাপে নেই। বরং ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কিছুটা কমেছে। অবকাঠামো নির্মাণ, অবকাঠামোর কাজ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজও নিয়মিত গতিতে চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালটি কেমন যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের দুটো দিক আছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং দেশীয় প্রেক্ষাপট। আগামী বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে বিরাট পরিবর্তন আসছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্থলে আসছেন জো বাইডেন, যারা ‘ডেমোক্র্যাট’। অনুমান করা হচ্ছে—অনেক পরিবর্তন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে আসবে।
চীন-আমেরিকার বাণিজ্যের অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা বিবেচ্য বিষয়। ভারত-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক কেমন দাঁড়াবে, আরেকটি বিচার্য বিষয়। চীন, ভারত ও আমেরিকা বড় বড় অর্থনীতির দেশ।
তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব মন্দা দীর্ঘায়িত হবে বলে ধরেই নেওয়া যায়। এর ওপর আমাদের ভবিষ্যত্ও নির্ভরশীল। চীন ও ভারত আমাদের আমদানির উত্স। আবার ইউরোপ ও আমেরিকা হচ্ছে—আমাদের রপ্তানিবাজার। তারা স্বাভাবিক হলে আমরাও উপকৃত হই। তবে মনে হয় আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবী আগের জায়গায় ফিরে যাবে না।
‘ইউনিপোলার’ বিশ্বের স্থলে আসবে ‘বাইপোলার’ বিশ্ব। আগে ছিল ‘আমেরিকা-রাশিয়া’, এবার হবে আমেরিকা-চীন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, উদারীকরণ ইত্যাদি। বোঝাই যায়—২০২১ সালের করোনা-পরবর্তী বিশ্ব আগের বিশ্ব থাকবে না।
একইভাবে বাংলাদেশও একই জায়গায় থাকতে পারবে না। ‘করোনা-১৯’ আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ করেছে, সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করেছে। ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষাজীবন থেকে একটি বছর ঝরে গেছে।
বহু প্রাণ ঝরে গেছে। হাজার হাজার মানুষ এখনো করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মানুষ আবার আশঙ্কায় ভুগছে। ভয়-ভীতি যাচ্ছে না। বয়স্করা ঘরবন্দি-গৃহবন্দি।
কত দিনে এই অবস্থা কাটবে তাও কেউ জানে না। আশার কথা, করোনার টিকা আসছে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। সবাই টিকা পেতে পেতে ২০২১ কেন ২০২২ সালও লেগে যেতে পারে।
তাই মনেই হয়, ২০২১ সালটিও পূর্ণ স্বাভাবিক হবে না। তবে সমাজ কিছুটা গতিশীল হবে। অর্থনীতি কিছুটা গতি পাবে। ব্যবসাবাণিজ্য আগের জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার মানুষ যারা চাকরিচ্যুত, ব্যবসাচ্যুত হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে সরকারঘোষিত নতুন প্রণোদনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারকে নজর দিতে হবে পুনর্গঠনের দিকে।
পুনর্জীবন নয়, দরকার পুনর্গঠন। অনেক ধুলাবালি জমেছে অর্থনীতিতে। এগুলো সাফ করে আমাদের এগোতে হবে। যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটাতে সময় লাগবে কমপক্ষে দুই বছর। সাবধানে কাজ করতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়