মাউশির ডিজির একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার !
বিলাসবহুল সরকারি গাড়ি ব্যবহারে প্রতিযোগিতায় মেতেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কর্মকর্তারা। পদ নয়, ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে সংস্থার উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকরা নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন প্রকল্পের দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। মাউশির শীর্ষ এক কর্মকর্তা দামি ব্র্যান্ডের নতুন দুটি গাড়ি ব্যবহারের পাশাপাশি তার স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যও একটি গাড়ি সংরক্ষণ করছেন। অথচ তিনজন কর্মকর্তা পরিচালক হয়েও বিধিবহির্ভূত প্রভাব খাটাতে না পারার কারণে লক্কড়-ঝক্কড়মার্কা গাড়ি ব্যবহার করছেন। অভিযোগ রয়েছে, মাউশির অধীন বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর গাড়ি ব্যবহারে দীর্ঘদিন ধরে নৈরাজ্য চলে এলেও বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর গোলাম মো. ফারুক বলেছেন, মাউশির সব গাড়িই ডিজির (মহাপরিচালক) নামে। নিজে দুটি গাড়ি ব্যবহার করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে দুটি গাড়ি ব্যবহার করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাউশির ডিজি ব্যবহার করছেন পাজেরো স্পোর্ট ব্র্যান্ডের নতুন দুটি গাড়ি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৫-০১০৭ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-০১০৮)। আর তার স্ত্রীও ব্যবহার করছেন বিলাসবহুল একটি সরকারি গাড়ি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৫-৫৫৭৭)। এ গাড়িটি কেনা হয়েছিল খাগড়াছড়ি জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিইও) জন্য। তিনি কিছুদিন ব্যবহার করেছিলেনও। ২০১৬ সালের জুনে মাউশির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক (বর্তমানে মাউশির ডিজি) জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে খাগড়াছড়ির ডিইওর গাড়িটি নিজ কার্যালয়ে নিয়ে নেন। পরে ওই গাড়িটি চট্টগ্রাম কার্যালয়ে রেখে পরিচালকের গাড়িটি মাউশির প্রধান কার্যালয়ের নামে নিয়ে তৎকালীন ডিজি প্রফেসর ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান তার স্ত্রীর ব্যবহারের জন্য রাখেন। গাড়িটি এখন বর্তমান ডিজির স্ত্রী ব্যবহার করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
প্রকল্পের অধীন প্রায় ৭০ লাখ টাকায় গাড়িটি কেনা হয়েছিল। গাড়ি ফেরত নেয়ায় খাগড়াছড়ির শিক্ষা কর্মকর্তা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও দাফরিক কাজে যাতায়াত করছেন পাবলিক পরিবহনে। যানবাহন সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি মাঠপর্যায়ে শিক্ষা পরিদর্শন কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ির ভারপ্রাপ্ত ডিইও সাধন কুমার চাকমা বলেন, খাগড়াছড়ি শিক্ষা অফিসের নামে একটি গাড়ি রয়েছে। সেটি ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। গাড়িটি সম্ভবত এখন হেড অফিসে (মাউশি) রয়েছে। গাড়ি না থাকায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শন করছেন কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাড়া করা গাড়িতে। কখনও কখনও হেঁটে, পাবলিক পরিবহনে।
মাউশির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, খাগড়াছড়ির ডিইওর গাড়িটি ২০১৬ সাল থেকেই এখানে। তাহলে এ কর্যালয়ের পরিচালকের গাড়ি কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মাউশির ডিজিকে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আমি যতটুকু জানি, তিনি চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিচালক থাকাকালীন গাড়িটি মাউশির ডিজিকে দিয়েছিলেন।
ওই গাড়িটি এখন কোথায় রয়েছে জানতে চাইলে মাউশি ডিজি বলেন, গাড়িটি চট্টগ্রাম কার্যালয়েই রয়েছে।
মাউশির উপ-পরিচালক (প্রশাসন) রুহুল মমিন ব্যবহার করছেন একটি গাড়ি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৩-৭২৩৭)। আর সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ব্যবহার করছেন অরেকটি গাড়ি (ঢাকা-মেট্রো-চ-৫৬-০৩০৭)। সহকারী পরিচালকের গাড়ি দিয়ে মাউশির অন্যান্য শাখার কর্মকর্তারাও যাতায়াত করছেন। নিয়ম অনুযায়ী ডিজি ও পরিচালক ছাড়া সংস্থার নিচের স্তরের কর্মকর্তারা গাড়িপ্রাপ্য নন।
মাউশির প্রশাসন শাখার সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার মানোন্নয়নের দুটি প্রকল্পের টাকায় প্রায় দু’তিন বছর আগে মাউশির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), পরিচালক (অর্থ ও ক্রয়), ডিজি ও শিক্ষামন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য পাজেরো ব্র্যান্ডের চারটি গাড়ি কেনা হয়। ওই চারটি গাড়ি কেনার আগে শিক্ষামন্ত্রী ও ডিজির নামে নতুন গাড়ি ছিল। কেনার পর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ওই নতুন গাড়িটি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ ১৫-০১০৭) মাউশিতে ফেরত পাঠান। তিনি পুরনো গাড়িটিই ব্যবহার করেন। এরপর নতুন গাড়িটিও মাউশির ডিজি অতিরিক্ত হিসেবে ব্যবহার করেন।
গত ৭ জানুয়ারি নতুন শিক্ষামন্ত্রী হন ডা. দীপু মনি। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর তাকে ওই গাড়ি দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করেন মাউশির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এতে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি মন্ত্রী হিসেবে যে গাড়িটি পেয়েছি, সেটিই ব্যবহার করব। আমার নতুন বা অতিরিক্ত গাড়ি লাগবে না।’ এরপর থেকে ওই গাড়িটি মাউশির ডিজি অতিরিক্ত বা রিজার্ভ গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। অথচ মাউশির তিন পরিচালক কখনও পুরনো ও লক্কড়-ঝক্কড়মার্কা গাড়ি দিয়ে, কখনও পাবলিক পরিবহনে যাতায়াত করছেন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাউশির কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাউশির ডিজির একটি গাড়ির জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে সংস্থার প্রশাসন শাখা। এরপরও বিকল্প উৎস থেকে জ্বালানির ব্যবস্থা করে ডিজিই গাড়িটি ব্যবহার করছেন বলে জানা গেছে।
টিচিং কোয়ালিটি ইম্প্রুভমেন্ট (টিকিউআই-২) প্রকল্পটি শেষ হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। এই প্রকল্পের অধীন ১০৫টি গাড়ি রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী বাস্তবায়ন শেষ হলে প্রকল্পের সব মাল মাউশিকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি। এখন এই প্রকল্পের চারটি গাড়ি মাউশিকে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। শিক্ষা প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকেই একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন বলে মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রকল্প শেষ প্রায় সাত মাস আগে। তাহলে গাড়িগুলো কারা ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে সমাপ্তকৃত টিকিউআই-২ প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মজুমদার বলেন, গাড়িগুলো মাউশিতেই রয়েছে। কেউ ব্যবহার করতে পারছেন না। কারণ গাড়িগুলোর ড্রাইভার নেই। জ¦ালানিরও সংস্থান নেই। আগামী ২-৩ দিনের মধ্যেই গাড়িগুলো মাউশিকে বুঝিয়ে দেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিকিউআই-২ প্রকল্পের পিডির ব্যবহার করা প্রায় আড়াই কোটি টাকার দামের (পাজেরো ব্র্যান্ডের) গাড়িটি বর্তমানে নায়েমে (জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি) সংরক্ষিত রেখে ব্যবহার করছেন মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা। বাকি তিনটি মাইক্রোবাস বর্তমানে মাউশিতেই রাখা হয়েছে। এগুলো নিয়মিবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করছেন মাউশি ও প্রকল্প কর্মকর্তারা। অথচ সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি চাওয়া হয়েছে মাউশির কাছে। সেটি দিতে পারছে না মাউশির কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাউশির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) জাকির হোসেন বলেন, টিকিউআই প্রকল্পের একটি গাড়িও আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। প্রকল্পের অন্যান্য মালও মাউশিতে হস্তান্তর করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, টিকিউআই প্রকল্পের ১০৫টি গাড়ির মধ্যে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন ৬৩টি। ৯টি আঞ্চলিক অফিসের কর্মকর্তারা ব্যবহার করছেন আরও ৯টি গাড়ি। ১০-১২টি গাড়ি ব্যবহার করছেন মাউশির অন্য কর্মকর্তারা। আর ১৫-২০টি গাড়ি নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন স্তরের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা।
সূত্র : দৈনিক সংবাদ