বুয়েটে অকাল মৃত্যু সানি থেকে আবরার
এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিতে চাই
সত্যি কথা বলতে কি এই পৃথিবীতে কেউ মরতে চাই না। কিন্তু সবাইকে মরতে হয় -এটাই বাস্তবতা এটাই স্বাভাবিক এটাই চিরন্তন সত্য। এর চাইতে নির্মহ সত্য পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু সেই মৃত্যুটা যদি অকাল মৃত্যু হয় সে মৃত্যুটা যদি অস্বাভাবিক হয় তবে সেটা বেদনাবিধুর অনেক কষ্টের অনেক বেদনার।
২০০২ সালের ৮ জুন সানি নামের স্বপ্নটার অকাল মৃত্যু হয়। সানি নামের কেমিকৌশল বিভাগের সেই মেয়েটি ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছে। কিন্তু সেই ক্যাম্পাসে একটা নিরীহ ছাত্রীর মৃত্যু, মনে হলো যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ক্লাস না হওয়াতে সনি উত্তরা বাসায় চলে যাচ্ছিল। এ সময়ই একটা বুলেট এসে তাকে আঘাত করে।
পরবর্তীতে জানা যায় ইউআরপি বিভাগের নতুন বিল্ডিংয়ের টেন্ডার চলছিল সে সময় ক্যাম্পাসে। সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের দুই গ্রুপের মারামারি ও গোলাগুলির ক্রসফায়ারে পড়ে হারিয়ে যায় সানির জীবন। তারপরের কাহিনি হয়তো কমবেশি সবারই জানা, জাতীয় দৈনিকগুলোর সুবাদে। অপরাধীদের একজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে প্রতিবাদে। সানিদের ব্যাচ (৯৯) অনশনে বসে বিচারের দাবিতে।
কিন্তু পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে আন্দোলন পন্ড হয়ে যায় । আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা করা হয়। তাদের বলা হয় বখাটে ও উচ্ছৃঙ্খল। বলা হয় কিছু ছেলেময়ে পড়াশোনা করতে চায় না, পরীক্ষা পেছানোর জন্য আন্দোলন করে। বিভিন্ন অযুহাতে সেই সনির অকাল মৃত্যু অণ্যখাতে নেওয়ার চেষ্টা চলে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর গড়ে মাত্র ০.০২% মেয়েরা পড়তে আসতে পারে। বেশির ভাগ ক্লাসেই ছাত্রছাত্রীর অনুপাত থাকে ১০: ১।
সেখানে একটা মেয়ে শুধু নিজে সেখানে পড়তে আসে না, সে একটা স্বপ্নকেও নিয়ে আসে। হয়তো সানির বাবা-মার এমন অনেক স্বপ্ন ছিল। হয়তো সনি বেঁচে থাকলে একজন প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী হতো। না সেগুলো কিছুই হয়নি, হওয়ার নয়। সনি মারা যাওয়ার পর সানির মাকে দেখেছি ছাত্রী হলে সনির রুমে এসে কাঁদতে আর নামাজ পড়তে। তিল তিল করে বড় করে তোলা সন্তানকে একটা বুলেটের আঘাতে এক মুহূর্তে হারিয়ে ফেললে বাবা-মার কেমন কষ্ট হতে পারে এই নরপশুরা তা বোঝে না।
২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষ, নজরুল ইসলাম হলের ২২৪ নম্বর কক্ষের ছাত্র আরিফ রায়হান দ্বীপকে। তার অপরাধ সে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী।
দ্বীপের অপরাধ, শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম পোস্টার রচনা করলেন কেন! দ্বীপের অপরাধ ছিল, ‘এই পথে আজ জীবন দিব, রক্তের বদলা ফাঁসি নেব’-এই স্লোগান নিজ হাতে লিখে শাহবাগ আন্দোলনের প্রাক্কালে রাস্তায় নেমে এসে কেন প্ল্যাকার্ড জাতির সামনে তুলে ধরেছিল! দ্বীপের অপরাধ, দ্বীপ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিল! দ্বীপের অপরাধ, দ্বীপ মৌলবাদগোষ্ঠী হেফাজতের বিরুদ্ধে লিখত, দ্বীপ স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে লিখত!
ব্যস! এই লেখালেখির কারণে, মতের অমিল হওয়ায় তথাকথিত হেফাজত নামক মৌলবাদী সংগঠনের সমর্থক বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মেজবাহ নামক ‘অমানবিক মেধাবী’ ছাত্রটি আরিফ রায়হান দ্বীপকে বুয়েট ক্যাম্পাসে হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। দুমাস জীবন-মরণ যুদ্ধ শেষে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে দ্বীপ এ পৃথিবী থেকে চিরতরের জন্য চলে যায়।
গত ৫ অক্টোবর ২০১৯ কুষ্টিয়ার কুমারখালীর নিজ বাড়ি থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ফিরেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ। সংবাদমাধ্যমের খবর, গভীর রাতে তাকে একই হলের দোতলায় একটি কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। সেটি ছাত্রলীগ নেতাদের বিশেষ কক্ষ। এখানে সাধারণ ছাত্র ও সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। কিল-থাপ্পড়, পেটানোর ঘটনা অহরহ ঘটত। এটি সাধারণ ছাত্রদের কাছে টর্চার রুম বলেই পরিচিত। এই রুমেই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কী অপরাধ করেছিল ছেলেটি?
আবরার ফেসবুকে বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কের ওপর একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল। সে লিখেছিল- "
১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।"
এ স্ট্যাটাসে কারও প্রতি অবমাননাকর কিছু নেই, গালি নেই, অশালীন কিছু নেই। এটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও চুক্তি নিয়ে অভিমত। বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্যাটাস। আর অন্য কিছু থাকলেও তা দেখার দায়িত্ব ছাত্রলীগের নয়। দুই দেশের সমঝোতা স্মারক নিয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার সবার আছে। এটি কারও অপছন্দ হলে পাল্টা বক্তব্য, যুক্তি দিতে পারে। তর্ক-বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা যায় না। গণতন্ত্রের মর্মবাণী হচ্ছে- তোমার কথা শুনলে আমার গা জ্বালা ধরে, খুন চড়ে যায়- তবু তোমার কথা শুনব, তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষায় যদি প্রাণ দিতে হয়, তাও দেব।
বলা হচ্ছে, আবরার শিবিরকর্মী। এর কোনো প্রমাণ মিলছে না। তার পরিবারও অস্বীকার করেছে। যদি শিবিরকর্মীও হয়, তাই বলে তাকে হত্যা করা যাবে- এই লাইসেন্স ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে?
দায় এড়াতে পারে না রাজনৈতিক নেতৃত্ব। প্রচলিত রাজনীতিই ছাত্রনেতা-কর্মীদের লাঠিয়ালে পরিণত করেছে। লাঠির ধর্ম লাঠিবাজি। তা থেকে তারা কী করে বিরত থাকবে? তাই তারা কখনও দলের জন্য লাঠিবাজি করছে, নিজেদের জন্য করছে; কখনও ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য করছে।
রাজনীতি এখন একরৈখিক। এ রাজনীতিতে সহঅবস্থানের কথা নেই। বাকযুদ্ধের কথা নেই। বর্তমান রাজনীতির নীতি- পথের কাঁটা রাখতে নেই। তাই যে দলই ক্ষমতায় যাক, বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতা স্থায়ী করতে চাইছে। বিরোধী দলও ক্ষমতার বাইরে কিছু ভাবছে না। ক্ষমতার জন্য সন্ত্রাসের পথ অবলম্বনে দ্বিধা করছে না।
ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। এ লড়াইয়ের বহিরাঙ্গে ভোট, ভেতরে পেশি ও কালো টাকা, যা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত। শুধু বর্তমান সরকারের আমলেই নয়, অতীতেও ছিল। বিএনপি আমলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ছাত্রদলেরই একক কর্তৃত্ব ছিল। বর্তমানে ছাত্রলীগের আধিপত্য। এই আধিপত্য পেশিশক্তির দাপটে; ছাত্রদের সমর্থনে বা ডাকসু, ইউকসু, চাকসুতে নির্বাচিত হয়ে নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যার যত সমর্থন, তার তত শক্তি। এই সমর্থন পেতে নেতৃত্বকে শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে হয়, বিনয়ী হতে হয়, যুক্তিতর্ক দিতে হয়।
এভাবেই পরমতসহিষুষ্ণতা গড়ে ওঠে। কিন্তু যেখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না, যুক্তিতর্কের ধার ধারতে হয় না; সেখানে কী করে পরমতসহিষুষ্ণতা গড়ে উঠবে? বরং আজ উল্টোটাই হচ্ছে। পেশির দাপট বাড়ছে। সেটিকে রাজনীতির হাতিয়ার মনে করছে। পেশির দাপট না থাকলে ছাত্রনেতাদের কর্তৃত্ব থাকে না, সিট বণ্টন-ভর্তিবাণিজ্য চলে না, মোটা অঙ্কের চাঁদাও মেলে না। তারা মনে করে, পেশি ছাড়া আখেরে উন্নতিও হবে না।
মূল কথা হচ্ছে, নষ্ট রাজনীতির ছত্রছায়ায় আমাদের শিক্ষার্থীরা মেধাবী হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে মানবিক-এর আগে ‘অ’ যুক্ত হয়ে বেড়ে উঠছে। ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী আজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে না-এটা নিশ্চিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন তাদের গবেষণার বিষয় বলে মনে করে না। কারণ, এই ছাত্রলীগকে কতিপয় সিনিয়র নেতা নষ্ট করে দিয়ে গেছে।
তিল তিল করে বড় করে তোলা সন্তানকে আঘাতের পর আঘাত করে এক মুহূর্তে হারিয়ে ফেললে বাবা-মার কেমন কষ্ট হতে পারে সেটা লেখার মতো ক্ষমতা আমার নেই। মনে হয় কেন পারি না আমার এই লাগামহীন আবেগ আর বিচ্ছিরি বিবেকটাকে মেরে ফেলে সরীসৃপ হয়ে যেতে। কেন এই সব অদ্ভুত চিন্তা করি, শুধু শুধু সময় নষ্ট করি। আসুন আমরা স্বার্থপর হই, ভালো থাকি, বেঁচে থাকি। শুধু মাঝে মাঝে যদি মনে পড়ে আমাদের সেই ভাই আবরার কথা গোপনে বলি, আমাদের ব্যর্থতা ক্ষমা কর আবরার ।
লেখক- প্রধান সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা ডট কম।