ঢাকা: রাজধানীর সরকারি সাত কলেজ নিয়ে গঠিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক ছাত্রীরা। তারা বলছেন, এটি বাস্তবায়ন হলে নারীদের উচ্চশিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, সংবিধানে থাকা সমান সুযোগের নিশ্চয়তা লঙ্ঘিত হবে। এ ছাড়াও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বাড়াবে, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্তির হলে বিশাল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে বলে উল্লেখ করেন তারা। একই সঙ্গে ইডেন কলেজসহ সাত কলেজের ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র মর্যাদা রক্ষায় সাবেক ছাত্রীরা সাতটি সুপারিশ তুলে ধরেন।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সুপারিশ তুলে ধরেন ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক ছাত্রীরা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ইডেন মহিলা কলেজর সাবেক ভিপি হেলেন জেরিন খান, প্রাণী বিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নিশরাত বেগম, সাবেক ছাত্রী খন্দকার ফারহানা ইয়াসমীন, অধ্যাপক সৈয়দা সুলতানা সালমা, রোকন সিদ্দীকী, ইসরাত জাহান পান্না, ফাহিমা আক্তার মুকুল, রাজিয়া সুলতানা, উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নাহিদ মনসুর।
সহশিক্ষা চালুর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা নারীশিক্ষার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার পরিপন্থী তারা বলেন, আমরা শান্তি চাই, স্থিতি চাই। ইডেন কলেজসহ সাত কলেজের ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র মর্যাদা যেনো বলি না হয়, ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজে যেনো সহশিক্ষা চালু না হয়, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ যেনো না হয় এটাই আমাদের কাম্য।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা আরো বলেন, সম্প্রতি ঘোষিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ সংক্রান্ত প্রস্তাব ও নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে এ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা সংকোচন ও স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হওয়ার আশংকা প্রবল হয়েছে। তাই আমরা ইডেন মহিলা কলেজ সাবেক ছাত্রীদের পক্ষ থেকে আমাদের স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করছি।
তারা বলেন, আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা কলেজ দীর্ঘকাল ধরে নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষত ধর্মপ্রাণ ও নিম্ন-আয়ের পরিবারের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এগুলো নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। কিন্তু খসড়া অধ্যাদেশের ৬(১) (খ) ধারা অনুযায়ী ইডেন ও বদরুন্নেসা কলেজে সহশিক্ষা চালুর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা নারীশিক্ষার নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার পরিপন্থী। এটি নারী শিক্ষার্থীদের পছন্দের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে এবং শতবর্ষব্যাপী নারী শিক্ষার ঐতিহ্য নষ্ট করবে। প্রস্তাবিত সংকোচন কার্যকর হলে রাজধানীতে নারীদের উচ্চশিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, তাদের প্রবেশাধিকার সংকীর্ণ হবে এবং সংবিধানে থাকা সমান সুযোগের নিশ্চয়তা লঙ্ঘিত হবে।
সংবিধানে ২৮(১) ও (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ২৮(৪) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়ার অনুমোদন রয়েছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি ৪.৩ ও ৪.৪) নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন। সুতরাং প্রস্তাবিত সংকোচন কেবল সাংবিধানিক দায়িত্বের পরিপন্থী নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ সেশনে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করার সময় আসন সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে। ফলে দেশের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে এবং তুলনামূলক সামর্থবান অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকবে, যা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বাড়াবে।
বক্তারা আরো বলেন, বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পেশায় ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা সফলতার সঙ্গে কর্মরত রয়েছেন। উল্লেখ্য ইডেন মহিলা কলেজের ৫১ জন সাবেক শিক্ষার্থী বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে নিজ কলেজেই কর্মরত আছেন, আর সারাদেশে এ সংখ্যা আরও বেশি। আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় হলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের পদ সেখানে সংকুচিত হয়ে যাবে। ইতোপূর্বে জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ফলে সেখানকার ৪০০+ পদ বিলুপ্ত হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য যে, গত ১০ বছরে এই ক্যাডারে কোনো নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি। বর্তমানে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হলে সাত কলেজের ১৪০০+ পদ বিলুপ্ত হলে তা ভবিষ্যত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার পদপ্রার্থীদের বিশাল সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।
ইতোমধ্যেই শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রস্তাবিত কাঠামোর প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করে আন্দোলনে নেমেছে। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাই সব অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ বিবেচনা না করলে ব্যাপক শিক্ষার্থী অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি তৈরি হবে।
ছাত্রীদের সুপারিশগুলো হলো: জাতীয় ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতায় ইডেন মহিলা কলেজকে বিলুপ্ত বা একীভূত করার উদ্যোগ অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত হবে। কলেজগুলোর বিদ্যমান অবকাঠামো, সক্ষমতা ও ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে ৭ কলেজকে কলেজিয়েট বা অধিভুক্তিমূলক কাঠামোর আওতায় রাখা। শিক্ষকদের পদ সংখ্যা বৃদ্ধি, গবেষণা বাজেট, আধুনিক ল্যাব, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, আবাসন ও বৃত্তি সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত যৌক্তিকীকরণ করা। পাশাপাশি পাঠদানকৃত বিষয়গুলো ও সিলেবাস পুনর্বিবেচনা করে যুগোপোযুগী করে তোলা। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের স্বার্থ সুরক্ষা করে শিক্ষা পরিবেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। সব অংশীজনের জানার অধিকার ও তথ্যের স্বচ্ছতা বজায় রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিকে অন্য কোন পৃথক ক্যাম্পাসে স্থাপন করে ঢাকার সাতটি কলেজসহ বিভাগীয় অন্য আরও শতবর্ষী কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করা।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৮/১০/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
