শেরপুরঃ শেরপুর জেলায় গারো, কোচ, হাজং, বানাই, ডালুসহ সাতটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এসব পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্পটা চলে মাতৃভাষাতেই। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে হাঁটতে হয় বাংলা ভাষার হাল ধরে। তাই দিন দিন নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, এতে আক্ষেপ তাদের। নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন।
দেখা যায়, ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কোচ পাড়ার সোনে বিদ্যালয়ে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। আর এমন অনেক বিদ্যালয় রয়েছে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে। এ বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীর সংখ্যায় বেশি। এ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। তাদের ভাষায় পড়তে ও শিক্ষক চায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা।
শুভশ্রী কোচ নামে স্থানীয় এক শিক্ষার্থী বলে, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী আমরা, স্কুলে বাংলা ভাষায় পড়ি। আমাদের ভাষা শেখায় না। আমরা সরকারের কাছে আমাদের ভাষা শিখতে চাই। আমাদের ভাষার বই চাই, শিক্ষক চাই।’
গৌরব হাজং নামে আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘আমাদের বাড়িতে হাজং ভাষায় কথা বলি। কিন্তু স্কুলে বাংলা ভাষা বলা লাগে। এতে আমাদের খুব সমস্যা।’
ষষ্ঠিনা কোচ বলে, ‘আমাদের স্কুলে কোচ ভাষায় পড়ায় না। খালি বাংলা পড়ায়। তাই আমরা আমাদের মায়ের ভাষা বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। আমরা চাই সরকার আমাদের ভাষার বই দিক, শিক্ষক দিক।’
জানা গেছে, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশে ২০১০ সালে আইন প্রণীত হয়। সে মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের জন্য ছয়টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষায় বই প্রণয়ন করে। সেগুলো হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল ও সাদ্রি ভাষা। তবে এসব ভাষার বই পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বিদ্যালয়গুলোতে। ফলে বইগুলো শিশুদের আদতে কোনো কাজেই আসছে না।
কোচ কালচারাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক যুগল কিশোর কোচ বলেন, ‘আমাদের ভাষার বই সরকার দিলেও তা পাঠদানের জন্য কোনো শিক্ষক দেয়নি। আমরা চাই আমাদের ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটা আদিবাসী এলাকার স্কুলেই বাংলা ভাষা পড়তে সমস্যা হয়। আমরা চাই পাহাড়ি এলাকায় আদিবাসী ভাষার শিক্ষক ও বই যেন দেই। এতে করে আমাদের আদিবাসী ভাষা টিকে থাকবে।’
কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার বই থাকলেও শিক্ষক না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষার শিক্ষক না থাকায় বিপাকে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এতে করে বাংলা ভাষা পড়াতে ও বাংলা ভাষার সাথে তাদের পরিচয় করতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষকদের।
শিক্ষক হালিমা খাতুন বলেন, ‘আমরা যখন শিশু শ্রেণিতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী ভর্তি করি, তখন আমাদের খুব সমস্যা হয়। তারা আমাদের ভাষা বুঝতে পারে না আমরা তাদের ভাষা বুঝি না। এতে করে আমাদের যেমন সমস্যা তেমনি তাদের পড়াতেও আমাদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হতে অনীহা প্রকাশ করে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, শেরপুর জেলায় ২০ হাজার ৮৪০ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করছেন। এর মধ্যে গারো ৪৪ দশমিক ০২ শতাংশ, বর্মা জনগোষ্ঠীর ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ, কোচ ১০ দশমিক ২৪ শতাংশ, হোডি ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, হাজং ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ, ডালু ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ০ দশমিক ৩৩ শতাংশের বসবাস।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘এ উপজেলাগুলোতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস বেশি। তাদের জীবনযাত্রায় যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে তাদের ভাষায়ও তেমন বৈচিত্র্য রয়েছে। তারা পরিবারের সাথে নিজস্ব ভাষায় ভাব বিনিময় করে থাকে। এ ভাষাগুলো আমাদের ঐতিহ্য। সেগুলো সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সাথে ও পাশাপাশি বাংলা একাডেমিসহ অনান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এ বিষয়ে পত্র দেব।’
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/০২/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.