নিজস্ব প্রতিবেদক।।
সড়কে চলাচলকারী সব ধরনের মোটরযানের জন্য লাইসেন্সের পাশাপাশি বাধ্যতামূলক হতে যাচ্ছে বিমাও। ২০২০ সালের আগেও এমন আইন অবশ্য ছিল। ওই সময় ফার্স্ট পার্টি পলিসির আওতায় যানবাহন দুর্ঘটনার পর বিমা দাবির টাকা ফেরত পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো গ্রহীতাদের। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যে অর্থ আদায় হতো তাও ছিল যতসামান্য। এ ছাড়া থার্ড পার্টি পলিসির আওতায় মোটরযান বিমা করা হলেও দাবির এক টাকাও পেতেন না যানবাহনের মালিকরা।
ওই সময় বিমা দাবির এমন হাজার হাজার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মোটরযান বিমা প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ বিমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। পাঁচ বছর পর বিমা কোম্পানির স্বার্থে ফের প্রচলিত আইনে যুক্ত হতে যাচ্ছে বিমা বাধ্যবাধকতার ব্যাপারটি। তাই আবারও যানবাহন মালিকদের হয়রানির পথ তৈরি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তবে এবার প্রথম পক্ষ বা তৃতীয় পক্ষ পলিসি নয়, নতুন নামে নতুন বিমা পলিসির প্রস্তাব সংশোধন করা হচ্ছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বিমা করা না থাকলে প্রতিটি যানবাহনের জন্য তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে তার মালিককে। আর আইন না মানলে মামলা করবে পুলিশ।
জানা গেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে দুই ধরনের গাড়িবিমা ছিল ফার্স্ট পার্টি বা প্রথম পক্ষ বিমা ও থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ বিমা। প্রথম পক্ষ বিমায় গাড়ি হতে হবে একদম নতুন। এ ক্ষেত্রে বিমা করালে বিমা কোম্পানি সেই গাড়ির শর্ত সাপেক্ষে সুবিধা দিত। সে ক্ষেত্রে গাড়ির মালিককে বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম দিতে হতো বিমা কোম্পানিকে। আর তৃতীয় পক্ষ বিমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তকে আর্থিক সুবিধা দিতে এই বিমা পলিসি করা হয়। এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছিল অকার্যকর।
মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষ বিমা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এ তৃতীয় পক্ষ বিমার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যানবাহনের বিমা করার বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হয় মালিকের ইচ্ছার ওপর। মূলত এরপর থেকেই মালিকেরা পরিবহনের বিমা করা প্রায় বন্ধ করে দেন। বর্তমানে যেসব পরিবহন চলাচল করছে, তার সিংহভাগেরই কোনো বিমা নেই।
বিমা বন্ধ করে দেওয়া অসংখ্য গাড়ির মালিকদের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী হাসান মিয়া। ২০১৭ সালে ২৫৯ টাকা দিয়ে নিজের মোটরসাইকেলের জন্য তৃতীয় পক্ষ বিমা করান। এই বিমার মেয়াদ ছিল এক বছর। এরপর ২০২০ সালে বিমার বাধ্যবাধকতা উঠে গেলে হাসান সেই বিমা নিয়ে আর কোনো খোঁজ নেননি। এ বিষয়ে হাসান বলেন, ট্রাফিক পুলিশের মামলা থেকে রেহাই পেতে তিনি বিমা করেছিলেন।
শরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী ৪ হাজার ৭৮২ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেলের ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স করেছিলেন। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের কাছে একবার দুর্ঘটনার শিকার হন। বিমা কোম্পানিতে দাবি পরিশোধের দাবি জানালে চার মাস পর তিনি ২ হাজার টাকা পান। শরিফুল ইসলামের মতো দেশে নিবন্ধন করা মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী আছেন ৪৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৩ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই আছেন ১১ লাখ ১৪ হাজার ৮০১ জন।
আর নিবন্ধন করা মোট যানবাহনের সংখ্যা ৫৯ লাখ ৮২ হাজার ৭৬৫। বিআরটিএ সূত্র বলছে, দেশে এখন নিবন্ধন করা ৯০ ভাগ গাড়ির কোনো বিমা নেই। বাকি ১০ ভাগ বাণিজ্যিক গাড়ি বা নতুন গাড়ির বিমা রয়েছে। সেগুলো প্রথম পক্ষ বিমা। সেডান গাড়ির ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম সর্বনিম্ন ৬৪ হাজার ৭৮৩ টাকা ও সর্বোচ্চ ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকা।
বেসরকারি চাকরিজীবী রাকিবুল ইসলাম ২০১৬ নিজের প্রাইভেট কার কেনার সময় ৬৪ হাজার ৭৮৩ টাকা দিয়ে ফার্স্ট পার্টি বা প্রথম পক্ষ বিমা করেছিলেন। এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীর বিজয় সরণিতে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় পড়ে। এরপর বিমা দাবি করেন তিনি। তিনি জানান, বিমা কোম্পানি সাড়ে ৪ মাস বিভিন্ন ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে ১৮ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই অর্থ আদায়ে রীতিমতো বড় ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে বিমা খাত নিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগ। সেই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভাগটির ডিন মো. নুরুল কবীর। তিনি বলেন, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে দুই ধরনের গাড়িবিমা ছিল- ফার্স্ট পার্টি বা প্রথম পক্ষ বিমা ও থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ বিমা।
প্রথম পক্ষ বিমায় গাড়ি হতে হবে একদম নতুন এটাই ছিল শর্ত। এ ক্ষেত্রে বিমা করালে কোম্পানি সেই গাড়ির শর্ত সাপেক্ষে সুবিধা দিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এই টাকা পেতে অধিকাংশ মানুষ নানা ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। এবার অবশ্য থার্ড পার্টি বিমা বাধ্যতামূলক হচ্ছে না। আগে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম ছিল ৩৬০ টাকা, ইন্স্যুরেন্স না থাকলে জরিমানা ১ হাজার ৫০০ টাকা।
এটা ছিল অযৌক্তিক একটা চিন্তা। তবে এবার কেউ গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনায় কবলিত হলে সে ক্ষতিপূরণ পাবে এমন পলিসি তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতা বলছে, এবারও লাভবান হবে শুরু বিমা কোম্পানিগুলো। ক্ষতিপূরণ পেতে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিমা না থাকলে পুলিশি হয়রানি বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই দেশের বিমা খাতের ভাবমূর্তি নেতিবাচক।
তারা যথাসময়ে গ্রাহকের দাবি পূরণ করে না। এখানে আস্থার একটা সংকট তো রয়েছেই। মানুষ বাধ্য না হলে বিমা কোম্পানির কাছে যেতে চায় না। এবার সরকারের পক্ষ থেকে বিমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। লাভবান হবে বিমা কোম্পানি মালিকরা।
সড়ক পরিবহন সংশোধন আইন, ২০২৪-এ বিমা বাধ্যতামূলক করায় যানবাহনের জন্য নতুন বিমা পলিসি নিয়ে কাজ শুরু করেন বিমা খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নতুন আইন অনুযায়ী বিমার ধরন পরিবর্তন হচ্ছে।
সেখানে প্রথম বা তৃতীয় পক্ষ বিমা নামে কিছুই থাকবে না। বরং নতুন একটি ‘প্রোডাক্ট’ আনা হবে, যেখানে প্রথম পক্ষ বিমার মতো অনেক বেশি মাত্রার ক্ষতিপূরণ থাকবে না, আবার তৃতীয় পক্ষ বিমার মতো এটি অকার্যকরও হবে না। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় পক্ষ বিমা বাতিল করতে বলেছেন। এ জন্য নতুন কী প্রোডাক্ট আনা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করবে বাংলাদেশ বিমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। তারা যেটা বের করবে, সেটাই হবে।
বিআইএ নতুন গাড়ি বিমা নিয়ে আইডিআরএর সঙ্গে কাজ করবে বলেও জানান শেখ কবির। তিনি বলেন, ‘যেহেতু থার্ড পার্টি থাকবে না, তাই গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা লাগলে, মানুষ মারা গেলে, গাড়ির ক্ষতি হলে সেখানে যেন ক্ষতিপূরণ পায়, সেই ব্যবস্থা থাকবে। ফার্স্ট পার্টিতে যেমন অনেক ক্ষতিপূরণ পায়, সেটাও না, আবার থার্ড পার্টির মতোও না।’
এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান জয়নাল বারী বলেন, ‘আগে থার্ড পার্টি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল। এবার থার্ড পার্টি বিমায় বিমা বাধ্যতামূলক হচ্ছে না। এবার নিজের গাড়ির ক্ষতির (ওন ভেহিকল ড্যামেজ) জন্য এই বিমা করতে হবে। কেউ গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনায় কবলিত হলে সে ক্ষতিপূরণ পাবে। এতে গাড়ির মালিকের লাভ। থার্ড পার্টি ছিল অন্য কারও লাভ। সেটি এখন আর নেই। ফার্স্ট পার্টি বা কম্প্রিহেন্সিভ বিমাও এখন অপশনাল। নিজের গাড়ির বিমা হবে বাধ্যতামূলক।
এই বিমা না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।’ প্রিমিয়াম কেমন হতে পারে, জানতে চাইলে আইডিআরএ চেয়ারম্যান বলেন, এবার থেকে গাড়ির দাম অনুযায়ী যা আসবে, সেই মোতাবেক বিমা করতে হবে। গাড়ির মূল্য অনুযায়ী প্রিমিয়াম দেবে। এখানে নতুন-পুরনো কোনো বিষয় নয়।
গাড়িবিমা নিয়ে নতুন উদ্যোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বিমা করা সব সময় ভালো। কিন্তু সমস্যা যেটা থেকে যায়, সেটা হচ্ছে এটার বাস্তবায়ন নিয়ে। মাঝখানে একটা বড় বিরতি দিয়ে এটা কার্যকর হচ্ছে। এখন দেখতে হবে, এখানে কোনো দুর্নীতি বা অন্যায়ের আশ্রয় যেন না থাকে।
জানা গেছে, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারায় দ-ের বিধানও ছিল। তবে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮তে তৃতীয়পক্ষের বিমা তুলে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যানবাহনের বিমা ছেড়ে দেওয়া হয় মালিকের ইচ্ছার ওপর। অর্থাৎ একজন ইচ্ছা করলে তার যানবাহনের বিমা করতে পারেন, আবার না করলেও কোনো সমস্যা নেই।
এ বিষয়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেয় বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এরপর থেকেই মূলত মালিকরা পরিবহনের বিমা করা প্রায় বন্ধ করে দেন। বর্তমানে যেসব পরিবহন চলাচল করছে তার সিংহভাগেরই কোনো বিমা নেই। তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমা তুলে দেওয়ার পর যানবাহনের বিমা বাধ্যতামূলক করার দাবি জানান বিমা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তবে কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্সে বাধ্যতামূলক করার সুযোগ না থাকায় বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে বিমা মালিকদের অংশগ্রহণে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বিমার আদলে নতুন একটি বিমা প্রোডাক্ট চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়। এরপর চলতি বছরের মার্চে যথাযথ নিয়ম মেনে বিমা না করলে তিন হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন (সংশোধন) আইন, ২০২৪’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
এরপর যানবাহনের জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ প্রণয়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অমল কৃষ্ণ ম-লকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। ওই কমিটি ইতোমধ্যে দুটি বৈঠকও করেছে। যেখানে বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করে এতে একটি উপধারা সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী উপধারাটিতে উল্লেখ থাকবে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ৬০(২) ধারার বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে তা হবে একটি অপরাধ এবং এই অপরাধের জন্য তিনি অনধিক তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ আইনটি সংসদে পাস হওয়ার পর সব ধরনের যানবাহনের জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বিমা বাধ্যতামূলক রেখে আইনের খসড়া অনুমোদন হয়েছে। আইনটি পাস হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শিক্ষাবার্তা/জামান/২৫/০৪/২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.