আলো ছড়াচ্ছে কুষ্টিয়ার বয়স্ক বিদ্যালয়

কুষ্টিয়াঃ শিক্ষার কোনও বয়স নেই। প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে মানুষ সারা জীবনই কোনও না কোনোভাবে শিক্ষা অর্জন করে। শিক্ষা নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের মতো বিষয়কে অনুসমর্থন করে; যা সমাজের জন্য চিরকল্যাণকর।

‘যতদিন বাঁচবো ততদিন শিখবো’— এটা যে শুধু প্রবাদ বাক্য নয়, তা প্রমাণ করেছেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরাইকোল গ্রামের ‘হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষার্থীরা। এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণকারী প্রত্যেকেই কর্মজীবী এবং বয়স্ক।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় আকমল হোসেন নামে এক আইনজীবী ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সাতটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক বয়স্ক পুরুষ ও নারী শিক্ষা গ্রহণ করছেন। তার এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে গ্রামে বয়স্ক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এরই মাঝে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রশংসা লাভ করেছেন। এরই অংশ হিসেবে সমাজের কর্মজীবী বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং অবহেলিত মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়।

স্থানীয়রা জানায়, এই বয়স্ক বিদ্যালয়ে নিরক্ষর কর্মজীবী মানুষদের বাংলা, ইংরেজি, গণিতের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাসহ কোরআন-হাদিস থেকে শেখানো হয়। শিক্ষার আলো থেকে ছিটকেপড়া স্বাক্ষরহীন মানুষগুলো এখন সংসার সামলিয়ে পড়ালেখা শিখছেন। শিখছেন দস্তখতসহ প্রয়োজনীয় সব লেখা-ঝোকা। অংকের গণনা থেকে শুরু করে বাংলা স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ, ইংরেজি এ বি সির সঙ্গে সুরে সুরে উচ্চারণ করতে পারেন আরবি হরফও। সেইসঙ্গে দৈনন্দিন চলাফেরায় কী কী দোয়া-দরুদ প্রয়োজন, তাও আয়ত্ত্ব করে ফেলেছেন বয়স্ক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এই বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণকারী স্থানীয় শমসের আলী (৪৫) পেশায় একজন ভ্যানচালক। বাল্যকালে অভাব অনটনে স্কুলের গন্ডি পেরতে না পারলেও মনে ছিল শেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই এতো বছর পর আজ তিনি হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের ছাত্র।

সারা দিন ভ্যান চালিয়ে সন্ধ্যার পর বিদ্যালয়ে আসেন শুধু শমসের আলী নয় তার মতো আরও অনেক কর্মজীবী মানুষ। সারা দিন বিভিন্ন কাজ শেষে বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে।

এই বিদ্যালয়ে পুরুষদের পাশাপাশি সমানভাবে শিখছেন নারীরাও। পুরুষদের জন্য পুরুষ এবং নারীদের জন্য পৃথকভাবে নিযুক্ত রয়েছেন নারী শিক্ষিকা।

বয়স্ক বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী রাবেয়া খাতুন বয়স প্রায় ৮০ কোটা ছুঁই ছুঁই তবুও শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে প্রতিনিয়ত আসেন হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে। বয়সের ভারে ঠিকমতো চোখে না দেখলেও কাপা কন্ঠে ক্লাসে শিক্ষিকার সাথে ব্ল্যাক বোর্ডের অক্ষরগুলি আয়ত্ত্ব করার নিরন্তর চেষ্টা করেন তিনি।

এই বৃদ্ধা বলেন, শেখার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল, কিন্তু অভাবের কারণে পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। এই বিদ্যালয়ের কল্যাণে এখন আমি সাত মাসে অনেক কিছু শিখেছি।

আরেক শিক্ষার্থী জাহানারা বেগম (৬৫) জানান, ‘গরীব ঘরে জন্ম নিয়েছিলাম। সময় মতো লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও টাকা পয়সার অভাবে শিখতে পারিনি। আজ এই বয়সে এসে অ্যাডভোকেট আকমলের স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়েছে।’

বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাইমা জান্নাত বলেন, ‘তাদের এই বয়সে এসে শেখার আগ্রহ দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হই। কোনোদিন ভাবতে পারিনি এমন বয়স্ক মানুষদের শিক্ষা দেবো। তারাও আমার পড়ানো বিষয়গুলো মনযোগ দিয়ে শেখার চেষ্টা করেন।’

হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাওলানা মো. আব্দুল মালেক বলেন, ‘সমাজের নিরক্ষরতা দূরীকরণে অ্যাডভোকেট আকমল স্যারের এমন উদ্যোগ। তিনি বয়স্কদের কথা চিন্তা করে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৭টি শাখায় দুজন শিক্ষক এবং ৮ জন শিক্ষিকার মাধ্যমে বয়স্কদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন বয়স্ক শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করেন। কর্মজীবী এবং বয়স্করা যাতে তাদের সংসারের কাজ সামলে নিয়মিত ক্লাস করতে পারে সে জন্যই বিকাল এবং সন্ধ্যা দুই বেলায় ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি শাখায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস করেন। এখানে শিক্ষার্থীদের বয়স সর্বনিম্ন ৩০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত। হাতেজান নেছা বয়স্ক বিদ্যালয়ে বয়স্ক শিক্ষার পাশাপাশি অর্থাভাবে স্কুল বঞ্চিত ঝরে পড়া শিশুরাও বিনা খরচে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়-পঙ্গু ও বিধবাদের মাঝে মাসিক ভাতা প্রদান করছে প্রতিষ্ঠানটি।’

বয়স্ক বিদ্যালয়ের পরিচালক অ্যাডভোকেট আকমল হোসেন বলেন, ‘সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের দোরগোড়ায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতেই আমার এমন প্রচেষ্টা।’ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শুধু কুমারখালী নয়, সমগ্র কুষ্টিয়া জুড়ে এধরনের শিক্ষার প্রসার ঘটবে বলেও মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল হক বলেন, ‘বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে সরকারের আলাদা নজরদারি রয়েছে।’ একইসঙ্গে গ্রাম পর্যায়ে এমন শিক্ষার আলো যারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদেরও সাধুবাদ জানান এই কর্মকর্তা।

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে আবেদনের সাপেক্ষে বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১২/০৪/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.