৫০ বছর পর ন্যায় বিচার পেলেন বাকৃবি ছাত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ ভগ্নাংশেরও কম নম্বরের জন্য বেআইনিভাবে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার ৫০ বছর ও মৃত্যুর এক বছর পর হাইকোর্টে ন্যায় বিচার পেলেন জিল হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখে এ রায় দেন।
এর ফলে, ২০০৮ সালে দেওয়া রায় অনুযায়ী দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন জিল হোসেনের পরিবার। সেই সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
আদালত জিল হোসেনের রায় প্রকাশের ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করেছে উল্লেখ করে বলেন, এই আচরণের কারণে জিল হোসেনের জীবন ধ্বংস হয়েছে। সময় মতো ফলাফল প্রকাশ হলে ও সনদ হাতে পেলে জিল হোসেনের জীবন অন্যরকম হতে পারতো।
১৯৭৩ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দশমিক পাঁচ নম্বরের জন্য জিল হোসেনকে বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে আবারও পরীক্ষায় বসলে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করলে দীর্ঘ ২২ বছর পর এবং হাইকোর্টের রায়ের ১৪ বছর পর ১৯৯৭ সালে ৪৭ বছর বয়সে সনদ হাতে পান তিনি। এরপর ২০০০ সালে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন জিল হোসেন। ২০০৮ সালে আদালত ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদনে হাইকোর্ট সে রায় স্থগিত করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান জিল হোসেন।
পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্নাতক পাসের পর তার বন্ধু-সহপাঠীরা যখন একে একে চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন তাকে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে সেই সনদ পেতে। আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তার হাতে পরীক্ষা পাসের সনদ আসে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ওই ঘটনার পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাননি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোট ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তার চার ছেলে ও চার মেয়ে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জিল হোসেন মারা যান।
আদালতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী তানিয়া আমীর ও মিয়া মো. ইশতিয়াক শুনানিতে ছিলেন। প্রয়াত জিল হোসেনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস। জিল হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে নিয়োগ দেন।
রায়ের পর চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ক্ষতিপূরণ বাবদ দুই কোটি টাকা দাবি করে মামলা করা হয়। এ মামলায় বিচারিক আদালত ২০০৮ সালে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রায় দেন। ওই দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে আরও ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিতে হবে। মোট টাকা থেকে ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদালতে জমা করা ২৫ লাখ টাকা বাদ যাবে। প্রয়াত জিল হোসেনের স্ত্রী ও আট সন্তান ওই অর্থ পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খামখেয়ালিপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য ও অবহেলার কারণে জিল হোসেনকে ভুগতে হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে এসেছে। কেননা, ভগ্নাংশ যোগ করে হলে ১৯৭৩ সালে কৃতকার্য থাকতেন জিল হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী মিয়া মো. ইশতিয়াক বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (অ্যাগ্রি) স্নাতক দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন তিনি। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তার প্রাপ্ত নম্বরের ১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায় সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এ মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়ে জিল হোসেনকে বহিষ্কার আদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবারও জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।’
পরিবার ও মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তার বয়স ৪৭ বছর, অর্থাৎ সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ। এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন।
এতে দাবি করা হয়, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে দিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ আপিল আজ খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা দেওয়ানি আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানসংক্রান্ত আদেশ স্থগিত করেন। শর্তে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলে ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর তথ্যমতে, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ টাকা সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট গত ডিসেম্বরে আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ৪ জানুয়ারি ওই অর্থ জমা দেয়।
জিল হোসেনের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদ আজ রায় ঘোষণার সময় তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
ন্যায়বিচার পেয়েছেন উল্লেখ করে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার বাবার শেষ ইচ্ছা ছিল মামলার রায় দেখে যাওয়ার। আজ তিনি বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। রায়ে সন্তুষ্ট, সত্যের জয় হয়েছে। বিচার পেতে ৪৮ বছর লেগেছে, বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিজমাসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। তবে রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়, সেই প্রত্যাশা রাখি।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়