১০০% উৎসব ভাতা ও জাতীয়করণ: স্বাধীনতা দিবসে এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি
।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
প্রায় কুড়ি কোটির ছোট্ট একটি দেশ। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করল। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে জন্মগ্রহণ করে দীর্ঘ ৯ মাস রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধের পর বহু শহীদের রক্ত এবং বহু নারীর সতীত্বের বিনিময়ে বিজয় অর্জন করেছিল। তখন বিশ্ব জনমতের একটি মহলে প্রচারিত হয়েছিল, বাংলাদেশ হলো একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু আজকে ২০২৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ বুক উঁচিয়ে বলতে পারে আমরা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ না আমরা উন্নয়নশীল দেশ।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্তি হচ্ছে, বাংলাদেশ টানেলের যুগে প্রবেশ করেছে কিংবা রকেট উৎক্ষেপণের শক্তি অর্জন করছে। কিন্তু দারিদ্র্য নিরসনের কাজটি ব্যাপকভাবে এখনো অবহেলিত। এটা সত্য যে, নিরন্ন, দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না এমন দরিদ্র লোক নেই কিন্তু ধনী ও দরিদ্র লোকের মধ্যে বর্তমান দশকগুলোয় বিশাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে।
বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়সম পার্থক্য সৃষ্টি । কত রকমের শিক্ষা আর কত রকমফের শিক্ষক তার ইয়ত্ত্বা নেই। বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগ সুবিধায় বিস্তর ফারাক।
অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সৃষ্টি করার পেছনে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল সব মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। দরিদ্র লোকের দারিদ্র্যের নিঃসঙ্কোচ নিরসন তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই স্বাধীন দেশে কেউ খাবে আর কেউ খাবেনা তা হবে না তা হবে না।
একটি দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে সেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে । সেই লক্ষ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তখন শিক্ষার্থীদের মাঝে বই, খাতা, পেনসিলসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হতো। পাশাপাশি বিদেশি বিস্কুট, ছাতু, দুধসহ নানা খাদ্যসামগ্রীও শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহ করা হতো। শিক্ষকদের অবস্থা বিবেচনা করে অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিল থেকে সাধারণ শিক্ষকদের ন্যায্যমূল্যে কাপড় সরবরাহের ব্যবস্থা করেন তিনি।
সে সময় সারাদেশে গড়ে তোলা হয় অসংখ্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ব্যবস্থার দিকনির্দেশনা প্রদান করার জন্য বিখ্যাত শিক্ষাবিদ বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা-কমিশন গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর একান্ত ইচ্ছায় ১৯৭৪ সালের মে মাসে একটি সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য নিয়ে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা-কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এই কমিশনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল জাতির প্রত্যাশা আর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাভাবনা। কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করার সুপারিশ করা হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছুদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান নামে বিশেষ একটি পদক্ষেপের কথা শিক্ষা-কমিশনে উল্লেখ করা হয়।
৫ বছরের মধ্যে ১১-৪৫ বছর বয়সী সাড়ে তিন কোটি নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দেয়ার প্রস্তাব ছিল এই শিক্ষা-কমিশনে। অর্থাৎ শুধু নিজে শিক্ষিত হলে চলবে না, বরং নিরক্ষরদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে সামাজিকতা তৈরি ও দেশ গঠনে অবদান রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলতেন ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এ পর্যন্ত শুধু আমলাই সৃষ্টি করেছে, মানুষ সৃষ্টি করেনি।’ তিনি মানুষ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেন।
তিনি দেশ স্বাধীন হবার পপরই সমগ্র শিক্ষা নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিলেন। আর যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা ভিত্তি। তাই এই শিক্ষা নিয়েই ভাবনা শুরু করেন তিনি। গরীব দুঃখী মেহনতী মানুষের সন্তান দের কাছে শিক্ষাকে সহজভাবে পৌছে দিতেই প্রাথমিক শিক্ষাকে এক ঘোষণায় সরকারীকরণ করেন।
১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে বলা হয়, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা ভাষাই হবে শিক্ষার মাধ্যম। ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ অন্য একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে জানানো হয়, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বই পাবে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পাবে বাজার মূল্যের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের উদ্যোগে ৩৬ হাজার ১৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয় এবং বাড়ানো হয় শিক্ষকদের বেতন। এছাড়া নারীর উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষা চালু করার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং দর্শন এখন আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চায়।
গুণগত শিক্ষামান নিশ্চিত করা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের সুযোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন বাস্তবায়ন করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আলোকিত মানুষ তৈরি ও কল্যাণমুখী সমাজ দিকে ধাবিত হওয়া আবশ্যক।
অথচ দেশে শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর মাত্র দুই ভাগ সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুই ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারিরা পাচ্ছেন শতভাগ সুযোগ-সুবিধা আর ৯৮ ভাগ শিক্ষক কর্মচারিরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ১৯ বছর ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পাচ্ছেন, যা অমানবিক।
মাধ্যমিক পর্যায়ের এন্ট্রি লেভেলের একজন শিক্ষক ১২ হাজার ৫০০ টাকা স্কেলে উৎসব ভাতা পান ৩ হাজার ১২৫ টাকা। মাদ্রাসার একজন ইবতেদায়ি লেভেলের শিক্ষক ৯ হাজার ৩০০ টাকা স্কেলে উৎসব ভাতা পান ২ হাজার ৩২৫ টাকা।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে কোনো শিক্ষক, কর্মচারীর পক্ষেই এত অল্প টাকা নিয়ে আনন্দের সঙ্গে ঈদ করা সম্ভব নয়। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদানের ঘোষণা ও পরিপত্র জারি করে প্রায় পাঁচ লক্ষ শিক্ষকের পরিবারে হাসি ফোটাবেন এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। এটাই আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হোক।
লেখক- শিক্ষক ও গবেষক।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২৬/০৩/২০২৪